রাহুল দেখালেন মোদি কী শিখবেন
ভারতের তিন রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থান গেল ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজেপির হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় কংগ্রেস। মোদি জমানায় এ এক অভিনব ঘটনা। এসব রাজ্যে পদ্মের চাষ হয়েছিল বেশ ভালোভাবেই। কিন্তু ক্ষমতার শেষ দিকে এসে রাজ্য তিনটি হারানোর ঘটনা বড় ধাক্কা ছিল বিজেপির জন্য।
তিন রাজ্যের নির্বাচনের এক বছর আগে কংগ্রেসের নেতৃত্বে এসেছিলেন রাজীব-সোনিয়াতনয় রাহুল। নেতৃত্বে আসার পর রাহুল গান্ধীর কপালে নিন্দা-সমালোচনাই জুটেছে বিস্তর। তিন রাজ্য উদ্ধার করার পর দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে গেল। যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রাহুলকে নিয়ে যাচ্ছেতাই রকমের ঠাট্টা-তামাশা করেছে, ‘পাপ্পু’ বলে এত দিন খেপিয়েছে, সেখানেও তাঁর প্রশংসার বন্যা বয়ে যেতে দেখেছি।
মহারাষ্ট্রের মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার (এমএনএস) প্রধান রাজ ঠাকরে বলেই বসলেন, ‘গুজরাট নির্বাচনে একা লড়েছেন রাহুল গান্ধী; কর্ণাটক তো বটেই। এবারে নির্বাচনে দেখা গেল, পাপ্পু পরম পূজ্য হয়ে উঠেছেন। জাতীয় স্তরে তাঁর নেতৃত্ব কি গ্রহণযোগ্য হতে চলেছে!’
এত প্রশংসায় রাহুলের কিন্তু হেলদোল নেই। সেই চেনা বিনম্র রাহুল ভোটের ফলাফলের দিন সন্ধ্যায় গণমাধ্যমের মুখোমুখি হাজির, যা তিনি সব সময় করেন। পাঁচ বছরের ক্ষমতায় থাকার সময় যাঁর দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটিবারও গণমাধ্যমের মুখোমুখো দাঁড়ানোর ‘সাহস’ দেখাননি। রাহুল কিন্তু কখনোই পালিয়ে বেড়ান না। যা হোক, সংবাদ সম্মেলনে এসেই তিনি তিন রাজ্যের মানুষ ও নেতা-কর্মীদের ধন্যবাদ দিলেন। তাঁর ধন্যবাদের বৃত্তের মধ্যে বিরোধীরাও থাকলেন। একসময় এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, আপনি কি বিজেপিমুক্ত ভারত চান?
শান্ত-সৌম্য রাহুল অকপটে বললেন, ‘এবার আমরা ওদের হারিয়েছি। ২০১৯–এর নির্বাচনেও হারাতে চাই।’ হিন্দিতে রাহুলের কথা, ‘লেকিন কিসিকো মিটানেকি কাম হাম নেহি করতে। উসসে হাম বিসওয়াস নেহি করতে।’
বাংলা করলে যা দাঁড়ায়, ‘কাউকে নিশ্চিহ্ন করার কাজ আমরা করি না। এতে আমার বিশ্বাস নেই। আমরা লড়াই করে ওদের হারাতে চাই। এ লড়াইয়ে সবাই থাকবে।’
কী বলা যায় এসব? নিছক রাজনৈতিক রেটোরিক? এমনটা কেই বলতেই পারেন। মোদি ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়ার কথা বলেছিলেন। রাহুল এর উপযুক্ত জবাব দিলেন। কিন্তু নির্বাচন শেষ হওয়ার পর তিন রাজ্য দাপিয়ে বেড়ানো নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর সঙ্গী বিজেপি সভাপতির মধ্যে কোনো বিনয় দেখা যায়নি। অমিত শাহ তিন রাজ্যের নবনির্বাচিতদের শুভেচ্ছা জানানোর মতো সৌজন্যবোধ দেখাননি। প্রায় মধ্যরাতে টুইটবার্তায় শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী মোদি। তিনি তিন রাজ্যের নতুন সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ কারার প্রতিশ্রুতি দেন। এত বিলম্বিত শুভেচ্ছার মধ্যে কি একধরনের ‘জোর করে হরিভক্তির’ মতো ব্যাপার থেকে যায়নি? ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার সাবেক রাজনৈতিক প্রতিবেদক অনিন্দ্য জানা তখন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মোদির শুভেচ্ছা জানানোটা রাহুলের সন্ধ্যাবেলার সংবাদ সম্মেলনের অভিঘাত।’
আরেকটি বিষয়। তিন রাজ্যে হারার পর ওই রাজ্যগুলোর বিজেপিদলীয় মুখ্যমন্ত্রীরা একে একে দায় স্বীকার করলেন। মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিং চৌহান, রাজস্থানের বসুন্ধরা রাজে এবং ছত্তিশগড়ের রমণ সিং দায় নিলেন নিজেদের কাঁধে। মোদি ও অমিত শাহ, যাঁরা পুরো নির্বাচনে তিন রাজ্যে দলের অলিখিত নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা কোনো ব্যর্থতার দায় নিলেন না। অথচ এর আগে যেকোনো রাজ্যে হারার দায় নিজে থেকে নিয়েছেন রাহুল। বিজয় হলে তার কৃতিত্ব ওই সব রাজ্যের মানুষকে এবং দলের নেতৃত্বকে নির্দ্বিধায় তুলে দিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি। এখানেই মোদি ও রাহুলের পার্থক্য।
ফিরে আসি সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে। ফল যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন আবার সংবাদ সম্মেলনে এলেন রাহুল গান্ধী। অবিচলিত, শান্ত চেহারার রাহুল ইতিমধ্যে নিজের দুটি আসনের একটিতে হেরে গেছেন। দল হারছে নিশ্চিত। সেই পরাজয় মেনে নিলেন দ্বিধাহীন চিত্তে। বললেন, ‘জনতা সবকিছুর মালিক। তাদের রায় মাথা পেতে নিয়েছি। জনতা বিজেপির পক্ষে রায় দিয়েছে। আমি তাদের শুভেচ্ছা জানাই। নরেন্দ্র মোদিজিকে শুভেচ্ছা জানাই।’
বাবা-মায়ের স্মৃতিধন্য আসন আমেথিতে জেতা স্মৃতি ইরানিকে শুভেচ্ছা জানাতে ভুললেন না। আমেথির মানুষ যে সম্মান স্মৃতিকে দিয়েছেন, তা তিনি রক্ষা করবেন, আশাবাদ রাহুলের। হিন্দি আর ইংরেজিতে রাহুল কথা বললেন। সংবাদ সম্মেলন পুরোটাই টিভিতে দেখার সুযোগ হলো। সুযোগ হলো ইতিহাসের এক পরাজিতের আন্তরিক স্বীকারোক্তির সাক্ষী হওয়ার।
নির্বাচনের দিন দুপুরেই শোনা যাচ্ছিল তিনি পদত্যাগ করতে চান। এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখেও পড়লেন। সামলালেন সহজভাবে। বললেন, সবে নির্বাচন শেষ হলো। দল আছে। তারা বসবে, সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে। একজন নেতার মতো কোনো উত্তেজনা না ছড়িয়ে নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করলেন সহনীয় গণতান্ত্রিক ভাষায়। রাহুল বললেন, ‘ভয় পাবেন না। একসঙ্গে থাকুন।’
পুরো নির্বাচনে রাহুলের প্রচারাভিযান মোটামুটি খেয়াল করেছি। প্রচারে জাতপাত নেই, ধর্ম নেই, অকারণ উত্তেজনা নেই। রাহুল কথা বলেছেন ভারতবাসীর দারিদ্র্য নিয়ে, শিক্ষার সমস্যা নিয়ে, কৃষকের আত্মহত্যা নিয়ে। নির্বাচনী প্রচারে বারবারই বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে কৃষকের ঋণ মওকুফ করাই হবে তাঁর মূল চ্যালেঞ্জ। আর বারবারই বলছিলেন, জনরায় যা হবে, তা তিনি মেনে নেবেন। জনতাই মালিক।
তিন রাজ্যে বিজয়ী রাহুলের বন্দনায় যাঁরা উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করেছেন, তাঁরা বোধ করি লাইন পাল্টেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবার রাহুলকে ধুয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার কী কী ব্যর্থতা, সেগুলোর বিশ্লেষণ চলছে। সেই মুহূর্তে এ প্রশ্নটা এসেই যায়, ফল যদি ভিন্ন হতো, বিজেপি যদি হারত, এ বদান্যতা মোদি-শাহরা দেখাতেন?
৫৬ ইঞ্চি ছাতাবিশিষ্ট মানুষদের অতীত আচরণ কিন্তু তা বলে না। তাঁরা একটি দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কথা প্রকাশ্যেই বলেছেন। সেখানে পরাজিত রাহুলের বিনয়, সৌজন্যবোধ দুর্বলতারই পরিচায়ক হয়তো। সব দেশে, সব কালে মানুষ হয়তো বিজয়ীর পক্ষেই থাকে। পরাজিতের বদান্যতাকে দুর্বলতা ভেবে করুণা করে। কিন্তু নেহরু-ইন্দিরা-রাজীব গান্ধীর রক্ত বহনকারী রাহুলের এই উদারতাকে যদি উপেক্ষা করা হয়, তবে তা হবে একধরনের নিষ্ঠুরতা। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আজকের বিজয়ী কাল পরাজিত হতেই পারেন। বিজয়ীরা পরাজিত রাহুলের কাছে থেকে অজানা ভবিষ্যতের শিক্ষা নিতেই পারেন। তাতে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের মঙ্গল বৈ খারাপ কিছু হবে না।