প্রবাসীদের বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে
গত অর্থ বছরে (২০১৭-২০১৮) প্রবাসীরা রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) পাঠিয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, এটি হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রবাসীদের পাঠানো দ্বিতীয় বৃহত্তম রেমিট্যান্স—এটা সত্যিই আমাদের জন্য সুখবর। তবে গত বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স পাঠানো হয়েছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে ৪৬ শতাংশ। ফলে এই রেমিট্যান্স বৃদ্ধির খবরটি বেশ বিভ্রান্তিকর।
তৈরি পোশাকের পর জনশক্তি রপ্তানি থেকেই সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে বাংলাদেশ। আর প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৬০ শতাংশই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। তাই এই খাতে মন্দাভাব প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভাবিয়ে তুলেছে। হুন্ডি প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা পাওয়ায় বেড়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। কিন্তু একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তির রপ্তানিও কমেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি কাজ করছেন সৌদি আরবে। সম্প্রতি সে দেশে ১৩ ধরনের কাজে বিদেশিদের কাজ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে বহু বাংলাদেশি চাকরি হারিয়েছেন। এ ছাড়া ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন অনেকে। তাই সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। এরপরও চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে সৌদি আরবে। তবে এখন তুলনামূলকভাবে নারী শ্রমিকই রপ্তানিই হচ্ছে বেশি।
কাতার এবং ওমানে আগে যেখানে প্রতি মাসে ৯-১০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী আসতেন, তা কমে এখন ৬-৭ হাজারে নেমে এসেছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বহু চেষ্টা করেও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) শ্রম বাজার এখনো খোলা সম্ভব হয়নি। গত পাঁচ বছর ধরে আরব আমিরাতে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এক সময় ছিল যখন কেবল দুবাইতেই এক থেকে দেড় লাখ কর্মী গেছে। এ ছাড়া কুয়েত, লিবিয়া ও ইরাকে কর্মসংস্থানের বাজার বলতে গেলে একবারেই বন্ধ।
কাতারে ভিসামুক্ত সফরের সুবিধা পাওয়ায় ভারতীয়রা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। বিভিন্ন পেশায় দক্ষ ভারতীয়রা কিছুদিনের জন্য কাতারের এসে চাকরিদাতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করছেন এবং চাকরি জোগাড় করে নিচ্ছেন। দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি দক্ষ জনশক্তি এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি পাকিস্তানিরাও ভিসামুক্ত দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
অবরোধের কারণে কাতারে নির্মাণ খাতের কাজ কিছুটা মন্থর হয়ে গেলেও অন্যান্য জিসিসি দেশগুলোতে বড় বড় প্রকল্পের কাজ কিন্তু থেমে নেই। সৌদি আরবে এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে বাদশাহ আবদুল্লাহ অর্থনৈতিক সিটি। জেদ্দা, আবুধাবি ও রিয়াদে হচ্ছে মেট্রো রেল। এ সব প্রকল্পে দক্ষ এবং পেশাদার জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। কেবল অদক্ষ এবং আধা দক্ষ শ্রমিক না পাঠিয়ে বেশি বেতনের দক্ষ জনশক্তি পাঠিয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব।
সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির পরিস্থিতি এখন খুব একটা ভালো নেই। এর জন্য আমাদেরও দায় আছে। প্রবাসীদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ ও হানাহানি অনেক সময় মানুষ খুনের মতো অনাকাঙ্খিত ঘটনায় গড়ায়, যা প্রবাসে একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে অহেতুক লড়াইও নষ্ট করে ফেলছে শ্রমবাজার।
ভিসা বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এখনো তা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এ ছাড়া আইনগত কাঠামোর মুখোশ পরে অনেকে এখন প্রতারণার নতুন ফাঁদ পাতছেন। কোম্পানি খুলে বৈধ উপায়ে কিছু মানুষ নিয়ে আসার এক বছরের মধ্যেই বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে, পরিকল্পনা মাফিক বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে কোম্পানি। এটি আইনের চোখে বৈধ হলেও ওই কোম্পানিতে আসা মানুষগুলো মাত্র এক বছরের মাথায় চাকরি হারিয়ে চরম সংকটে পড়ে যাচ্ছেন। আইনগতভাবে নতুন কোম্পানিতে যোগদানের সুযোগ থাকলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি নতুন চাকরি খুঁজে নেওয়া সহজ কাজ নয়। ফলে সবকিছু হারিয়ে অনেকে দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে আগত নারী শ্রমিকেরা হয়রানি, স্বল্প মজুরিসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। প্রতারণা ও নির্যাতন বন্ধের জন্য সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
বন্ধ শ্রমবাজার খোলার পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টির জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। কাতারে বাংলাদেশিদের ভিসামুক্ত সফরের সুযোগ তৈরি করার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা আরও কার্যকর এবং জোরদার করতে হবে। জনশক্তি রপ্তানির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে—এমন যাবতীয় সমস্যা সমাধান করার লক্ষ্যে সরকারের সব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একযোগে কাজ করা উচিত।
প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়াতে হলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যাপারে প্রবাসীদের উত্সাহী করতে হবে। এ জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আকর্ষণীয় প্যাকেজ চালু করতে পারে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের পথও সুগম করে দিতে হবে। প্রবাসীদের জন্য নিরাপদ এবং ভালো বিনিয়োগের উপায় হলো সরকারি ওয়েজ আর্নার বন্ড কিনে রাখা। বাংলাদেশ সঞ্চয় অধিদপ্তরের চালু করা পাঁচ বছর মেয়াদি ‘ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড’, তিন বত্সর মেয়াদি ‘ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড’ এবং ‘ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড’ নামের ভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগের চমৎকার সুযোগ রয়েছে। অন্য কোনো সঞ্চয়পত্র বা বন্ডে এত মুনাফা এখন পাওয়া যায় না। সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, মেয়াদ শেষ হলে এই টাকা দেশ হতে ফিরিয়ে আনা যায়। এগুলো সম্পর্কে বেশির ভাগ প্রবাসী তেমন ভালোভাবে অবহিত নন। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে জনসচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিতে পারে।
(লেখক: প্রকৌশলী ও গবেষক)