কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশ
কান ইজ নার্ভ-র্যা কিং। বাংলায় বলা যেতে পারে, কান উৎসব একটা স্নায়ুক্ষয়ী ব্যাপার। কথাটা গেল কান উৎসবে বলেছিলেন কেট ব্ল্যানচেট। অস্কারজয়ী এই অভিনেত্রীর দামি কথাটা মনে পড়ল বাংলাদেশে তৌকীর আহমেদের অজ্ঞাতনামা নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার পর। কান উৎসব আদতেই এক স্নায়ুক্ষয়ী যুদ্ধের নাম। এই যুদ্ধ শৈল্পিক, আবার একই সঙ্গে বাণিজ্যিক বা প্রচার-প্রচারণারও। অফিশিয়াল সিলেকশনে স্বর্ণপাম (পাম দর) বা স্বর্ণ ক্যামেরার (ক্যামেরা দর) মতো পুরস্কার জেতার যে লড়াই, সেটাকে আমরা বলতে পারি শৈল্পিক লড়াই। এর বাইরেও আবার আছে ধুন্ধুমার বাণিজ্যিক লড়াই। শিল্প, বাণিজ্য আর গ্ল্যামার মিলিয়ে কান উৎসব মানেই তাই মহা হুলুস্থুল। মহা ছোটাছুটি। বিশ্ব চলচ্চিত্রের রথী-মহারথীদের ঘুম হারাম। দক্ষিণ ফরাসি উপকূলে ১২টা দিন শুধুই মুক্তকচ্ছ ছোটাছুটি।
আগামী ১১ মে শুরু হচ্ছে ৬৯তম কান চলচ্চিত্র উৎসব। শুরুর আগেই এবারই সম্ভবত প্রথমবারের মতো কান উৎসব ঘিরে সরব বাংলাদেশও। তৌকীর আহমেদের অজ্ঞাতনামা ও অমিতাভ রেজার আয়নাবাজি—দুটি ছবিই মার্শে দু ফিল্মে দেখানোর কথা এবারের উৎসবে। এখানে বলে রাখা ভালো, মার্শে দু ফিল্ম কান উৎসবের মূল অফিশিয়াল সিলেকশনের বাইরে একটি পুরোপুরি বাণিজ্যিক বিভাগ। উৎসবের সময়ে প্যালে ডে ফেস্টিভ্যালের নিচতলার জায়গাটায় নির্দিষ্ট ফি দিয়ে যে কেউ তাঁদের ছবি দেখাতে পারেন। প্রযোজনা সংস্থাগুলোর সুযোগ থাকে বুথ বা টেবিল ভাড়া নিয়ে কাজ তুলে ধরার।
আমার দুই বছরের অভিজ্ঞতায়, খুব অনুরোধ-উপরোধ করে না নিয়ে গেলে কোনো দেশের সাংবাদিক-সমালোচকের এই এলাকার ছবি দেখার তেমন আগ্রহ দেখিনি। প্রযোজক-পরিবেশকদের আনাগোনাই বেশি দেখা যায় উৎসবের এই অঞ্চলে। কারণটাও সোজা।
উৎসবের সময়ে অফিশিয়াল সিলেকশনে জায়গা পাওয়া বিশ্বের নামীদামি আর নতুন সম্ভাবনাময় নির্মাতাদের সব ছবিই কারও একার পক্ষে দেখে শেষ করা মহা কঠিন। সেখানে মার্শে দু ফিল্মের ছবি বহু দূরের ব্যাপার। মনে আছে, দুই বছর আগে এ রকমই এক অনুরোধে ব্রাজিলের এক নির্মাতার সঙ্গে তাঁর ছবিটি দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে সব মিলিয়ে আমরা মোট আটজন দর্শক ছিলাম। তরুণ নির্মাতা এডওয়ার্ডো মোরায়েস সেটাতেই খুশি ছিলেন।
আপাতত আমরাও খুশি যে বাংলাদেশের নির্মাতা-প্রযোজকেরা দেরিতে হলেও কান উৎসবের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। উৎসবের সম্মানজনক অফিশিয়াল সিলেকশনের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেললে উদ্যোগটা বলতে হবে ভালো। অজ্ঞাতনামা ও আয়নাবাজি—এই দুই ছবির নির্মাতার জন্যই থাকল শুভকামনা।
তবে বাংলাদেশের জন্য আরও আদর্শ হতে পারত ভিলেজ ইন্টারন্যাশনাল নামের বিভাগটি। কোনো দেশের সিনেমা আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বাইরের দুনিয়ায় তুলে ধরার জন্য কান উৎসবে এটাই আসলে সেরা সুযোগ। সেই সুযোগটাই নিয়মিত নেয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা ভারত। এমনকি ইরান, আরব আমিরাত কিংবা মিসরের মতো দেশও পিছিয়ে থাকে না।
বাংলাদেশের ছবি একদিন সত্যি সত্যিই কান উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে জায়গা করে নেবে। তারেক মাসুদের মাটির ময়না যে গৌরব বয়ে এনেছিল, সেই গৌরবকেও নিশ্চয়ই ছাড়িয়ে যাবে অন্য কোনো নির্মাতার ছবি। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।