এই তো সেই অঞ্জন দত্ত
‘বেইলি রোডের ধারে আমি দেখেছি তোমায়।’ বাংলাদেশ নিয়ে লেখা তাঁর প্রথম গানের প্রথম লাইনটাই কী অদ্ভুতভাবে মিলে গেল! অঞ্জন দত্তের গান শুনে বড় হওয়া একটা প্রজন্ম তাঁকে প্রথম দেখল সেই বেইলি রোডের ধারে। না, এ গায়ক অঞ্জন নয়। এ সেই অঞ্জন, যা তিনি হতে চেয়েছিলেন।
মহিলা সমিতির ড. নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে কাল সেলসম্যানের সংসার-এ অঞ্জনের দেড় ঘণ্টার অভিনয় এতটাই ঘোর তৈরি করল, শেষ দৃশ্যের পর মুহুর্মুহু করতালি যেন থামতেই চাইছিল না। নাটকের প্রয়োজনে অঞ্জন কাঁদতে কাঁদতে হেসেছেন। হাসতে হাসতে কেঁদেছেন। তবে সে কান্না ছিল নিতান্তই উইলি লোম্যানের। জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক বাবা, একজন বুড়ো সেলসম্যানের কান্না।
কিন্তু নাটকের শেষে, সব শিল্পীদের হাতে হাত রেখে অঞ্জন যখন নুয়ে অভিবাদন নিলেন, সেই মুহূর্তে হলভর্তি দর্শক যখন দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানালেন অঞ্জনকে, আরও একবার কাঁদলেন তিনি। এ কান্নায় কোনো খাদ নেই। এই কান্না আবেগের!
কোথায় যেন উইলি লোম্যানের সঙ্গে শিল্পী অঞ্জনের মিল থেকে যায়। সেলসম্যান লোম্যানের গল্পটা বিখ্যাত নাট্যকার আর্থার মিলার নির্মাণ করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনীতির পাগলা ঘোড়ায় ছুটতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সেই আমেরিকান ড্রিম-এর সময়টায়। টাকা উড়ছে, শুধু ধরতে জানতে হবে।
ছাপোষা মধ্যবিত্তের জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল উইলি। বেছে নিয়েছিল সেলসম্যানের জীবন। নিজের তারুণ্যের সবটা সে ঢেলে দিয়েছিল সেই স্বপ্নের মধ্যে। উইলি তখনো জানত না, বাহারি কোটের নিচে গলায় যে টাইটা যে বেঁধেছে, সেটা আসলে গলায় বাঁধা একটা শেকল।
জীবনের শেষ অঙ্কে এসে চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা উইলি হিসাব মেলাতে পারছে না। ৩০ কিংবা ৩৫ বছর ধরে বাড়ির মর্টগেজের কিস্তি দিতে দিতেও শেষ পর্যন্ত একটা কিস্তি বকেয়াই থেকে যায়। দুই ছেলে বিফ আর হ্যাপির কেউই পায়ের নিচে মাটি পায়নি। এই সময়ে চাকরি হারানো! যে কোম্পানিকে জীবনের সোনালি সময়গুলো সে দিয়েছে প্রভুভক্ত দাসের মতো, শেষ বয়সে অচল মুদ্রার মতো তাঁকে ছুড়ে ফেলে সেই অফিসেরই বড় কর্তা।
কিন্তু উইলি কিছুতেই তাঁর তিলে তিলে গড়া সংসার এভাবে ভেঙে যেতে দেবে না। কিছুতেই না। বলতে না বলতেই তাঁর সংসারে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ঢুকে পড়ে অনেকে। কেউ ফুলদানি আছড়ে ভাঙে, কেউ ছুড়ে ফেলে দেয় চেয়ার। ঝনাৎ করে আছড়ে পড়ে টেলিফোন।
>ছাপাখানার ভূতের আয়োজনে মঞ্চনাটক সেলসম্যানের সংসার-এ অঞ্জন দত্ত শুধু উইলি চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেননি, নির্দেশনাও দিয়েছেন। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুপ্রভাত দাশ, সুদীপা বোস, অনির্বাণ চক্রবর্তী, উষ্ণক বসু, বর্ণা রাহা, অভিরূপ চট্টোপাধ্যায়, সুহর্ত্র মুখোপাধ্যায়। কাল নাটকের দুটি মঞ্চায়ন শেষে মোড়ক উন্মোচন করা হয় অভিনেতা অঞ্জনকে নিয়ে সাজ্জাদ হুসাইনের লেখা বই নাট্যঞ্জন-এর।
সেই ঝড় থেমে গেলে বুড়ো উইলি জীবনের শেষ শক্তি দিয়ে ঠেলে ঠেলে এলোমেলো চেয়ারগুলো আবার সাজায়। শরীর আর চলতে চায় না, পা ঘেঁষটে চলে মাটিতে। তবু এই তছনছ হয়ে থাকা ঘরটা আবার না সাজানো পর্যন্ত উইলির শান্তি নেই।
এ-ই হলো নাটকের গল্প। এই গল্প নিয়ে কাল দুবার দর্শকের সামনে হাজির হয়েছিলেন অঞ্জন। ৬৬ বছর বয়সে অঞ্জন প্রথমবার বাংলাদেশে এলেন মঞ্চ অভিনেতা হিসেবে। এখানেই উইলির সঙ্গে মিলে যায় তাঁর গল্প। গায়ক হিসেবে দুই বাংলাতেই কিংবদন্তির মর্যাদা পেয়েছেন। তবু জীবনের শেষ অঙ্কে এসে দাঁড়িয়ে শিল্পী সত্তার মর্টগেজের হিসাব যেন মিলছিল না। একটা কিস্তি বাকি!
কাল দুবারই নাটক শুরুর আগে গেয়ে শুনিয়েছেন। অন্তত একটা গান না হলে কি হয়! কিন্তু সেই গানের ফাঁকেই বলেছেন, ‘গায়ক আমি হতে চাইনি, আমি তো অভিনেতাই হতে চেয়েছিলাম।’ ক্যারিয়ারের শুরুর সেই বিন্দুটা মিলিয়ে দিয়ে বৃত্তটা পূরণ করতে তাই হয়তো আবার থিয়েটারে ফিরে যাওয়া। বাংলাদেশে আসার আগে বলেছিলেন, ‘অভিনেতা হিসেবে এই প্রথম আপনাদের সামনে হাজির হতে চলেছি, জানি না, অভিনেতা হিসেবে আবার হাজির হতে পারব কি না।’
অঞ্জন যদি নাও পারেন, এই একবারের স্মৃতিটাই তাঁর ভক্তেরা আজীবন মনে রাখবেন। এক কিস্তির জন্য উইলিকে হাত পাততে হয়েছিল। কিন্তু অভিনেতা অঞ্জন শেষ বাকি কিস্তি তাঁর ভক্তদের দিলেন দু হাত ভরে!
কাল দ্বিতীয় শোয়ের পর অবশ্য বললেন, ‘যে ভালোবাসা পেলাম, আমি আবার আসব বাংলাদেশে অভিনয় করতে। যদি কেউ টাকা নাও দেয়, তবু আসব। টাকা লাগবে না। যে ভালোবাসা পেলাম, এর চেয়ে বড় সম্মানী কিছু হয় নাকি!’