দেশের ঈদ বেশি আনন্দের
কী বলব বেদনার কথা! আমার জীবনে একবার এক ঈদ এসেছিল। ব্যান্ডের সঙ্গে ভ্রমণের কারণে একবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ঈদ করেছিলাম। জীবনে কেউ যদি আমাকে ভালোবেসে জিজ্ঞেস করে আপনার জীবনে বড় ভুল কী? আমি বলব সেই বিষাদগ্রস্ত ঈদের দিনের কথা। আমি হোমসিক মানুষ। ভিনদেশে প্রাণহীন সেই ঈদে আমি সেদিন আরও বেশি করে বুঝেছিলাম ঈদকে ঘিরে নিজের দেশ কী, পরিবার কী, বন্ধুরা কী, মগবাজারের মোড় কী (তখন মগবাজার থাকতাম), মায়ের হাতের খিচুড়ি কী, রাতের বেলায় টিভি লাইভে গান গাইতে গিয়ে ভক্ত–শ্রোতাদের অভিনন্দন পাওয়া কী। ভাইবোনের সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে ফোনো লাইভে প্রিয় ব্যান্ড অথবা পছন্দের শিল্পীর গান শোনা কী। সেদিন আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে আর যা-ই করি, প্রিয়জন, প্রিয় মানুষ, প্রিয় দেশ, প্রিয় শহর ছেড়ে ঈদটা অন্তত কোনো দিন আর কোথাও করব না।
সে যাইহোক। বড় হয়েছি। দায়িত্ব ও আনন্দের ধরন পাল্টেছে। তবু ঈদ এলে এখনো কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করে। আমার কাছে ঈদ হৃদয়ে রং ছড়ানোর উৎসব। সবার কী সুন্দর হাসি হাসি মুখ। কোনো দুঃখ নেই, ক্লান্তি নেই। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই। তাই ঈদ আমার কাছে মহামিলনের এক সর্বজনীন উপলক্ষও। ঈদ দেশ–কাল–পাত্রভেদে প্রিয়জনে ভালোবাসা, আবেগ, আনন্দ, সম্প্রীতিতে ভেসে যাওয়ার মহোৎসব।
ব্যক্তিগতভাবে আমার সব সময় মনে হয়, বাংলাদেশের ঈদ একটু বেশি আনন্দের। আমাদের এখানে ঈদ শুধু নতুন জামা-জুতা কিংবা সালামি আর সুস্বাদু খাবারের আয়োজনেই থেমে থাকে না। সারা দিন আত্মীয় কিংবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করা, আড্ডা দেওয়া, ঘোরাঘুরির পর রাতে বিশ্রামের ফাঁকে ফাঁকে অধীর আগ্রহে টিভির বিভিন্ন চ্যানেল ঘুরিয়ে একটু প্রিয় শিল্পীর গান অথবা প্রিয় অভিনেতা–অভিনেত্রীর নাটক কিংবা পছন্দের অনুষ্ঠানটা না দেখলে যেন ঈদ এখানে সম্পূর্ণ হয় না। এটা দারুণ এক ব্যাপার। সারা দিন থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চ্যানেলগুলোতে একটার পর একটা ভালো অনুষ্ঠান চলে। ঈদ ঘিরে চ্যানেলগুলোর সৃজনশীলতা বেড়ে যায়, সাজ সাজ রবে অভিনবত্ব বেড়ে যায়। শিল্পীরাও মন উজাড় করে তৈরি হন শ্রোতাদের তাঁদের সৃষ্টির সর্বোচ্চটুকু মেলে ধরতে। আনন্দ-খুশিতে পারস্পরিক লেনদেনের এক মধুর চিত্র ফুটে ওঠে চারকোনা এই বাক্সে, যাতে বরাবরই লাভবান দর্শক-শ্রোতারা।
সময় পেলে এখনো ‘ইত্যাদি’ দেখার চেষ্টা করি। কারণ, মনে আছে, ছোটবেলায় ঈদ বিনোদন মানেই ছিল বিটিভি আর বিটিভি মানেই ইত্যাদি। এখনো ইত্যাদি দেখতে গেলে সেই একই মজা পাই। তবে আমি যেহেতু গানের মানুষ। তাই স্বভাবতই সময় পেলে গানের অনুষ্ঠান দেখার চেষ্টা করি। নতুন নতুন ব্যান্ড, অনেক প্রতিভাবান শিল্পীর গান শুনতে ভালো লাগে। উইন্ড অব চেঞ্জের গান শুনতে ভালো লাগে। ঈদ ঘিরে গানের প্রযোজনার গান বাংলা চ্যানেলের উইন্ড অব চেঞ্জ যেকোনো রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। ঈদ আর গানকে ঘিরে তারা দেশে ও দেশের বাইরে দারুণ একটা উদাহরণ এবং আগ্রহ সৃষ্টি করে চলেছে কয়েক বছর ধরে। ভাবনা, বাস্তবায়ন, প্রযোজনা—সবকিছুতেই তাঁদের নতুনত্ব আনার আন্তরিক চেষ্টাটা সত্যিই চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া মিউজিক বাজের আয়োজনটাও ভালো লাগে। যেখানে সাবলীল উপস্থাপনায় থাকে গান ও গানের কথা। বিটিভির ঈদ স্পেশাল ব্যান্ড শো তো সব সময়ই আনন্দ দেয়। ফোনোলাইভে প্রিয় ব্যান্ডগুলোর গান শুনতে খুব ভালো লাগে।
আমরা চিরকুটও সব সময় চেষ্টা করি গান অথবা গানের বাইরে একটু ভিন্নভাবে ঈদে নিজেদের উপস্থাপন করতে। যেমন এবার ঈদ হবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটময়। তাই সময় টিভির উদ্যোগে চিরকুট ক্রিকেট খেলল, প্রতিপক্ষ আর্টসেল। দারুণ মজা হয়েছে। চার ওভারের গানরুদ্ধকর খেলাটি সময় টিভিতে দেখা যাবে ঈদের কোনো একদিন।
চৌকোনা পর্দায় এখন বিনোদনের মাধ্যম পরিবর্তিত হয়েছে। তাই টিভি ছাড়াও অন্তর্জালের দুনিয়ায় এখন বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে ঈদ ঘিরে ছোট–বড় আয়োজনে নতুন নতুন মজার সব অনুষ্ঠান দেখা যায়। নতুন নতুন মিউজিক ভিডিও, গান শোনা যায়। তাই বলা যায়, ঈদে বিনোদনকে ঘিরে পুরো বাংলাদেশ যেন একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য রঙিন ছবিতে পরিণত হয়, যার উৎসবমুখর দর্শক-স্রোতা থাকেন সারা দেশের আনন্দপ্রিয় মানুষ।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের প্রাণে ঈদ বিরাজ করুক প্রতিদিন। বিনোদনের রঙে, সম্পর্কের রঙে ঈদ ঘিরে মানুষে মানুষে যে সখ্য, যে আবেগ–উচ্ছ্বাস আমরা দেখতে পাই চারপাশে, তা দীর্ঘস্থায়ী হোক, তা কল্যাণ বয়ে আনুক সবার জীবনে—এটাই প্রার্থনা।
লেখক: সংগীতশিল্পী