উদীচীর ৫০ পূর্তি
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে নানা আকৃতির লাল রঙের ব্যানার। নানা বয়সের নারী-পুরুষের উচ্ছ্বসিত উপস্থিতি। বেশির ভাগের পরনে লাল পাঞ্জাবি আর লালপেড়ে সবুজ শাড়ি। চারদিক যেন লাল-সবুজের জয়জয়কার। এ রকম পরিবেশে শনিবার সকালে অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ৫০ বছর পূর্তির সমাপনী অনুষ্ঠান।
সময়টা ১৯৬৮। পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে বাংলার মানুষ। উঁকি মারছে একটি কালজয়ী গণ-অভ্যুত্থান। এ সময় সত্যেন সেনের নেতৃত্বে ঢাকায় ২৯ অক্টোবর ‘উদীচী’র আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। সত্যেন সেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা মিলে গড়ে তুলেছিলেন এই সাংস্কৃতিক সংগঠন। সেই সংগঠন শত বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে পেরিয়ে এসেছে ৫০টি বছর। আগামী সোমবার পূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর। এ উপলক্ষে গত বছর থেকেই শুরু হয় নানা অনুষ্ঠানমালা। ‘আঁধারবৃন্তে আগুন জ্বালো, আমরা যুদ্ধ আমরা আলো’ প্রতিপাদ্যে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার তিন দিনের সমাপনী আয়োজন শুরু হয়েছে আজ শনিবার।
আজ সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে এর উদ্বোধন করেন উদীচীর তিন সাবেক সভাপতি অধ্যাপক পান্না কায়সার, সৈয়দ হাসান ইমাম ও কামাল লোহানী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, উদীচীর উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান খান, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার, ফ্রান্সে ফরাসি সরকার কর্তৃক নির্মিত শহীদ মিনারের প্রকল্প প্রধান ও ওভারভেলিয়ার্সের ডেপুটি মেয়র অ্যান্থনি দাগেসহ অনেকে। আরও উপস্থিত ছিলেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক সফিউদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার। জাতীয় সংগীত ও সংগঠন সংগীত গেয়ে এবং জাতীয় ও সংগঠনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ আয়োজন। এখানে অংশ নেন উদীচীর তিন শতাধিক শাখা সংসদের কর্মী।
উদ্বোধনী পর্বে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে সমাজ সচেতনের কাজটি করে যাচ্ছে। দীর্ঘ পথচলায় সংগঠনটির বৈশিষ্ট্য ও কৌশলের হয়তো কিছু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সংগঠনটির মূল সুর নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কাজ করা, মানবতার পক্ষে কাজ করা এটি অব্যাহত রয়েছে। মোদ্দাকথা, উদীচী এ দেশের প্রগতিশীল সংস্কৃতির শক্তিশালী ধারা বহন করে চলেছে। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ৭৫-এর আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কালো অধ্যায়ের সময়ও উদীচীর সংগ্রাম থেমে থাকেনি। উদীচী মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অসাম্প্রদায়িকতা এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ অব্যাহত রেখেছে। মন্ত্রী বলেন, আমরা আধুনিক ও মুক্তচিন্তার একটি শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়তে চাই। আমাদের এ সংগ্রামে উদীচী একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে এবং রেখে চলেছে বলে আমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, সারা দেশে উদীচীর বহু কর্মী ও সংগঠক ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। তাঁদের কর্মকাণ্ডকে আরও শক্তিশালী করতে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।
উদীচীর সাবেক সভাপতিদের পক্ষে পান্না কায়সার বলেন, উদীচী গণমানুষের পাশে থাকার প্রত্যয় ও বিশ্বাস নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই প্রত্যয় ও বিশ্বাস এখনো সংগঠনটি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধসহ সব আন্দোলন-সংগ্রামে উদীচী রাজপথে ছিল। সাফল্যও এসেছে। কিন্তু উদীচীর যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে উদীচীর যুদ্ধ এখনো চলছে এবং সেই যুদ্ধেও উদীচী জিতবে।
উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে শহীদ মিনারের পাদদেশে উদীচীর শিল্পীরা পরিবেশন করেন উদীচীর ইতিহাস নিয়ে নির্মিত গীতি-নৃত্যালেখ্য। এরপর শহীদ মিনার থেকে বের করা হয় শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, শাহবাগ, মৎস্য ভবন ঘুরে শোভাযাত্রাটি এসে শেষ হয় শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। সেখানেই ছিল আলোচনা পর্ব।
এ সময় উদীচীর প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের চেয়ারপারসন অধ্যাপক মাহফুজা খানম, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ফকির আলমগীর এবং ফ্রান্সের প্যারিসের উবারভ্যালিয়ার্সের ডেপুটি মেয়র অ্যান্থনি দাগে। মধ্যাহ্ন বিরতির পর বিকেল চারটায় শুরু হয় উদ্বোধনী দিনের দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান। এ পর্বের শুরুতে উদীচীর প্রতি শুভেচ্ছা জানান বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অতিথিরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন সময়ে উদীচীর নানা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশ নেওয়া সংগীতশিল্পী শুভেন্দু মাইতি, কল্যাণ সেন বরাট, শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার, বিমল দে, বিপুল চক্রবর্তী, অনুশ্রী চক্রবর্তী প্রমুখ। এরপর প্রখ্যাত শিল্পী কল্যাণ সেন বরাটের শিল্পীজীবনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মানপত্র পাঠ ও উদীচীর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হয়। শুভেচ্ছা পেয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন কল্যাণ সেন বরাট।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা পর্বে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট শিল্পী কল্যাণ সেন বরাট, শুভেন্দু মাইতি ও পূরবী মুখোপাধ্যায় অংশ নেন। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা থেকে আসা উদীচীর শিল্পী-কর্মীদের পরিবেশনা।
২৮ ও ২৯ অক্টোবর উদীচীর সুবর্ণজয়ন্তী সমাপনী অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন। এ দুই দিন বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে থাকবে আলোচনা, পুনর্মিলনী ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে বিভিন্ন আমন্ত্রিত দল, শিল্পী এবং উদীচীর জেলা ও শাখাসমূহের বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশনা। দ্বিতীয় দিন ঢাকায় এবং বিভিন্ন জেলায় যেসব সাংস্কৃতিক সংগঠক উদীচী গড়ে তোলার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হবে।