সবটাই ‘আয়না করার’ খেলা। না, কথাটা ঠিক লাগসই হলো না। বলা দরকার ছিল, ‘আয়নাবাজি অরিজিনাল সিরিজ’-এর যে সাতটি নাটক প্রচারিত হলো ঈদের দিন থেকে পর পর সাত দিন, প্রতিটি নাটকেই ছিল একই চরিত্র, কার্যক্ষেত্রে একই অভিনয়শিল্পীর দ্বৈত রূপ। ব্যাপারখানা ‘আয়না করা’র কায়কারবারের মতোই অনেকটা। আর নির্মাতা অমিতাভ রেজার পৌরহিত্যে আয়নাবাজি সিরিজের মূল থিমও ছিল এটা। যেহেতু আয়নাবাজি সিনেমা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এবং ওই ছবির সিকুয়াল হিসেবেই বানানো হয়েছিল প্রতিটি ‘ফিকশন’, ফলে সদ্য সমাপ্ত ঈদ অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে যে সাত তরুণ নাট্যনির্মাতা সাতটি নাটক বানিয়েছেন, তাঁদের সবাইকেই নাট্যছক আঁকার আগে মাথায় নিতে হয়েছে ‘আয়না’র অভিন্ন ‘থিম’। বোধ করি, এই প্রকল্পের কোনো কোনো নাটকের ক্ষেত্রে বড় গড়বড়টা হয়েছে এখানেই। থিমের সঙ্গে গল্প ও নাটকের চমৎকার রাখিবন্ধন ঘটিয়ে সাত নির্মাতার অল্প কয়েকজন দুর্দান্ত ‘কাজ’ দেখিয়েছেন যেমন সত্যি, তেমনি গল্পের ওপরে মূল থিমটি বোঝা হয়ে যাওয়ায় অন্যদের নাটকের ভাগ্যে ঘটেছে ‘ধপাস’, মানে পড়ে গেছে, এ ঘটনাও মিথ্যা নয়।
আয়নাবাজি অরিজিনাল সিরিজ নিয়ে হইচই ছিল বেশ। তিনটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে একসঙ্গে এবং একই সময়ে প্রচারিত হয়েছে নাটকগুলো—আমাদের দেশের বাস্তবতায় এটা একেবারেই আনকোরা ঘটনা।
ঈদের দিন ২৬ জুলাই প্রচার হওয়া এই সিরিজের প্রথম উপস্থাপনা কৃষ্ণেন্দু চট্টপাধ্যায়ের নাটক ফুলফোটানোরখেলা। অপরাধ দুনিয়ার গল্প নিয়ে গড়ে ওঠা এই নাটকে রাশেদ শরীফ একজন ভয়ংকর কিলার। পুলিশ যেমন তার সন্ধানে ব্যাকুল, তেমনি প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী দলও হন্যে হয়ে খুঁজছে রাশেদকে। এর মধ্যে টাকার বিনিময়ে একজনকে খুন করে ঢাকা থেকে পালিয়ে কুষ্টিয়ায় এসে আশ্রয় নেয় সে। এখানে তার নাম অমিত। তো, এই কুষ্টিয়া শহরেই সে পেয়ে যায় আজান নামের এক দরিদ্র মালিকে। ঘটনা ‘প্যাঁচ’ খেতে শুরু করে এখান থেকে। কারণ, রাশেদ আর আজানের চেহারায় বিস্তর মিল। অমিল শুধু এটুকুই, রাশেদ যেখানে প্রবল ‘স্মার্ট’ ও চৌকস, আজানের ভেতরে সেখানে আছে সারল্য ও আনাড়িপনা। নাট্যগল্পের এই ‘মোচড়’কে সম্বল করে শুরু হলো ‘আয়নাবাজি’। বিপুল অর্থের লোভে পড়ে রাশেদ পরিচয়ে ঢাকায় গেল আজান। আর আসল রাশেদ পালিয়ে রইল কুষ্টিয়ায়। তার সঙ্গে প্রেম হলো নদী নামে এক মেয়ের।
নাটকের গল্পটি নন লিনিয়ার ঘরানার। আর এখানে যে বিশদভাবে গল্পটি বলা হলো, তা কেবল ‘আয়নার খেলা’ স্পষ্ট করার খায়েশে। বলা ভালো, নাটকে গল্প এগিয়েছে ‘আয়নাবাজি’র সঙ্গে মিল রেখে। তো, এবার এর অভিনয় ও নির্মাণের দিকে চোখ ফেরানো যাক। রাশেদ আর আজান—দুই চরিত্রেই অভিনয় করেছেন মনোজ কুমার। এই দ্বৈত ভূমিকায় তাঁর অভিনয় এককথায় অনবদ্য। একই অভিনেতার দুই চরিত্র রূপায়ণে নির্মাতা কৃষ্ণেন্দু চরিত্রকে দিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন ‘মুদ্রাদোষ’। স্বভাব ও অভিব্যক্তিতে রাশেদ যেমন নির্লিপ্ত ও স্থির, আজান তেমনি ভীত ও অস্থির। উপরন্তু এই চরিত্রটি ভিন্ন হয়ে ওঠে ‘খুক খুক কাশি’ দেওয়ার কারণেও। নাটকে সানজিদা প্রীতি ও মিশু সাব্বিরের অভিনয় ছিল দৃষ্টিনন্দন। শট বিভাজন ও নির্মাণেও ছিল মুনশিয়ানার ছাপ। বিশেষত, নাটকটি আগাগোড়া ছিল চলচ্চিত্রিক ‘ট্রিটমেন্টে’ ভরপুর। টিভি নাটকের প্রথাগত ক্লোজআপ শটের বদলে লং শট, মিড শর্ট, ড্রোন শট প্রভৃতির বিচিত্র ব্যবহার ফুলফোটানোরখেলাকে প্রতিমুহূর্তে নান্দনিক করে তুলেছে।
আয়নাবাজি সিরিজের আর যে কয়েকটি নাটক কাহিনি ও নির্মাণ সৌকর্যে চোখে লেগে আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো অমিতাভ রেজার মার্চমাসেশুটিং। নাটকের নামই বলে দিচ্ছে শুটিংয়ের প্রেক্ষাপটে এগিয়েছে এর গল্প। কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’ কবিতা অবলম্বনে একটি সিনেমার শুটিং হবে। এ জন্য চলচ্চিত্র নায়ক আবরার খান ওরফে শুভ এসেছে পাবনায়। ঘটনাচক্রে সে এমন এক বাড়িতে উপস্থিত হয়, যে বাড়ির মা চরিত্রটির স্মৃতি এখনো আটকে আছে ১৯৭১ সালে। এরপর নাটকের কাহিনি আমাদের জানায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই মায়ের ছোট ছেলে বিশু রায় গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। সে আর ফেরেনি। ঘটনার ঘনঘটায় আজ এত বছর পর আবরার যখন সেই বাড়িতে উপস্থিত, তখন মা তাকে শনাক্ত করছে নিজের হারানো ছেলে বিশু হিসেবে। কারণ, সময় ভিন্ন হলেও বিশু আর আবরারের চেহারার মিল হুবহু। ফলে অবধারিতভাবে এখানেও শুরু হলো ‘রিয়েল লাইফে অভিনয়’ অর্থাৎ ‘আয়না’র ক্রীড়া।
নির্মাণকুশলতার জন্য তো বটেই, নাটকটি দাঁড়িয়ে যায় তার চমকপ্রদ গল্পের কারণেও। গল্পটি প্রবলভাবে রাজনৈতিক। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বাস্তবতা ও স্বপ্ন এবং এই সময়ের পুঁজিবাদি সমাজ—এ দুইয়ের ভেতরে এক চমৎকার বোঝাপড়া স্পষ্ট এখানে। নাটকে হৃদি নামের চরিত্রের সঙ্গে কথোপকথনের একপর্যায়ে আবরার বলে, ‘দেশ তো স্বাধীন।’ তার কথার বিপরীতে হৃদির মুখে শোনা যায় ভাবনা জাগানো সংলাপ, ‘আপনার কি মনে হয় আপনি একটি স্বাধীন দেশে বাস করেন?’ নাটকটির রাজনৈতিক ব্যাকরণ বুঝতে এটি একবার নয়, বারবারই দেখতে পারেন দর্শক।
এই নাটকের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই যে নির্মাণ ও উপস্থাপনার দিক থেকে এটি খুব সাদামাটা। তবে এই সাদামাটা নাটকই আমাদের মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করে, আমাদের ভাবায়। তা ছাড়া অপূর্ব ও নাবিলার সাবলীল অভিনয়ও এই ‘সিম্পল’ নাটককে দিয়েছে অনন্য দ্যোতনা।
সাত নাটকের মধ্যে ২ জুলাই শেষ দিন প্রচারিত হয় শেষটাএকটুঅন্যরকম। গৌতম কৌরীর পরিচালনায় এই নাটকও ভালো এবং ‘অন্যরকম’। এখানে আছে থিয়েটারশিল্পী আজিমের গল্প, যে ‘আজিম’ ও শেক্সপিয়ারের ‘ওথেলো’—এই দুই চরিত্র ও দুই সত্তার মধ্যে একাকার। আজিম ও ওথেলো—দুই চরিত্রে আশীষ খন্দকারের অভিনয় অনেক দিন মনে থাকবে। বিশেষ করে মঞ্চে ওথেলো আর বাস্তবে আজিম চরিত্রের রূপায়ণে একই আশীষ যেভাবে মুহূর্তেই দুই রকম অনুভব জাগিয়ে তোলেন, তা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। অভিনয় গুণে নাটকটি যেন তিনি তিনি একাই টেনে নিয়ে গেছেন। এ নাটকে দেখা গেল বেশকিছু ‘থিয়েট্রিক্যাল ট্রিটমেন্ট’, যা একে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে। এমন নিরীক্ষাধর্মী নাটকের জন্য নির্মাতা গৌতম কৌরী নিশ্চয় ধন্যবাদ পাবেন।
আয়নাবাজি সিরিজের অন্যান্য নাটক হলো সুমন আনোয়ারের রাতুলবনামরাতুল, আশফাক নিপুণেরদ্বন্দ্বসমাস, তানিম রহমানের কী? কেন? কীভাবে? ও রবিউল ইসলামের মুখোমুখি। এই চারটি নাটক সিরিজটির শোভা বাড়িয়েছে বটে, কিন্তু ওপরে আলোচ্য তিন নাটকের তুলনায় কাহিনি ও নির্মাণের দিক দিয়ে এগুলো যথেষ্ট মাজুল। গল্পের বাস্তবতাকে ঠিকঠাক চিত্রায়ণ করার চেয়েও কারও কারও ঝোঁক ছিল সুন্দর দৃশ্য নির্মাণের দিকে (যেমন, মুখোমুখি)। নাটকগুলোতে যদিও কেউ কেউ সু-অভিনয় করেছেন (যেমন, দ্বন্দ্বসমাস-এ রওনক হাসান, রাতুলবনামরাতুল-এ আজাদ আবুল কালাম), তবু ওই যে প্রথমে বলেছি—সিরিজের মূল থিম ‘আয়না খেলা’ চেপে বসেছে গল্পের ওপর—এই নাটকগুলোর ক্ষেত্রে অবিকল তা-ই ঘটেছে। ফলে এখানে আয়নার খেলা জমেনি তেমনভাবে।