শিক্ষার্থীদের নিজেদের দুনিয়া
প্রায় ১৬ হাজার ছাত্রছাত্রীর পদচারণে মুখর, প্রাণোচ্ছ্বল এক প্রাঙ্গণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তৌহিদী হাসান
শিশুতলা থেকে সারা দেশে
সংগঠনটির নাম ক্যানসার অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম ফর উইমেন, সংক্ষেপে ক্যাপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের একপাশে, শিশুতলায় বসে একসময় ছোট আকারে সভা করতেন এর সদস্যরা। এখন সেই সংগঠন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশের নানা জেলায়।
ক্যাপ গড়ে ওঠার পেছনে একটা গল্প আছে। ২০১৫ সাল, সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মুছা করিম তখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই মুছা জানতে পারেন, তাঁর দাদি জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত। দাদি নানা রকম সমস্যায় ভুগছিলেন অনেক আগে থেকেই, কিন্তু লজ্জা ও সংকোচের কারণে কাউকে বলেননি। মুছা যখন দশম শ্রেণিতে পড়তেন, তখন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন তাঁর মামিও। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখা এই তরুণ বুঝতে পারেন, একটা কিছু করা দরকার। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ক্যাপের যাত্রা শুরু করেন তিনি।
‘যদি ক্ষতির কারণ লজ্জা হয়, তাহলে আর লজ্জা নয়’ স্লোগানে ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যানসার সচেতনতার কার্যক্রম শুরু হয়। তবে এখন কুষ্টিয়া ছাড়াও ঢাকা, যশোর, টাঙ্গাইলে ছড়িয়ে পড়েছে ক্যাপ। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কলেজ, মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কাজ করছেন এই সংগঠনের সঙ্গে। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে লিফলেট বিতরণ করেন, আলোচনা সভার আয়োজন করেন। যেন শিক্ষার্থীরা এই দুই ক্যানসার সম্পর্কে সচেতন হন, একই সঙ্গে তাঁদের পরিবারের মা-বোনসহ সবাইকে সচেতন করতে পারেন।
মুছাদের এই কার্যক্রম শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে তাঁরা আয়োজন করেন উঠান বৈঠক। কয়েকটি গ্রামের নারীদের একসঙ্গে জড়ো করে লিফলেট ও ফ্লিপচার্টের মাধ্যমে তাঁরা বুঝিয়ে বলেন, স্তন ও জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায় কী। জানান, কোন ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পেলে সংকোচ না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ঢাকা, কুষ্টিয়া, যশোর, টাঙ্গাইল মিলে প্রায় চার শ স্বেচ্ছাসেবী যুক্ত আছেন এই সংগঠনের সঙ্গে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ আবদুল্লাহ আল মাহদী বলেন, ‘আমাদের এই কার্যক্রম স্বেচ্ছাসেবীদের আর্থিক অনুদানে চলে। প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবী মাসে ৫০ টাকা করে চাঁদা দেন। এ ছাড়া কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন, যাঁরা বিভিন্ন আয়োজনে আর্থিক সহায়তা দেন।’
প্রাঙ্গণের প্রাণ মফিজ লেক
ক্যাম্পাসের একদম পশ্চিম দিকে সবুজে ঘেরা লেকটির নাম মফিজ লেক। কখন কীভাবে কেন এই নামকরণ, কে জানে! তবে এই মফিজ লেকই এখন ১৭৫ একরের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের প্রাণ, শিক্ষার্থীদের আড্ডা জমে ওঠার স্থান।
প্রায় ১০০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই লেকে রয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন সেতু। সন্ধ্যা হলেই সেতুতে রঙিন বাতি জ্বলে ওঠে। লেকের পানিতে চোখে পড়ে লাল শাপলা। পাশেই ওয়াচ টাওয়ার ও বোটানিক্যাল গার্ডেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ যদি কেউ ঘুরে দেখতে যান, মফিজ লেকে না গেলে ভ্রমণটা অপূর্ণই রয়ে যাবে।
আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু ডায়ানা চত্বর
ক্যাম্পাসের এক ডজন চত্বরের মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম ডায়ানা চত্বর। মূল ফটক দিয়ে ঢুকে, প্রশাসন ভবনের সামনে সারি বেঁধে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আলবেজিয়াগাছ। জনশ্রুতি আছে, ব্রিটেনের প্রিন্সেস ডায়ানা যে বছর মারা যান, তখন থেকেই চত্বরটির নাম হয়ে গেছে ডায়ানা চত্বর। বসন্তে, চারপাশে লাগানো সোনালু ফুলের গয়না পরে ডায়ানা চত্বর সাজে নতুন রূপে। ক্লাসের ফাঁকে কিংবা ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে আড্ডা দেন এখানে। তৈরি হয় বন্ধুত্ব আর হাসি-কান্নার নতুন নতুন গল্প। কেউ ছুটির পর গাড়ির অপেক্ষায় এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। কারও আড্ডা দেশের রাজনীতি থেকে শুরু হয়ে পৌঁছে যায় মহাকাশ অবধি। দিন শেষে সবাই চলে যান, কিন্তু ডায়ানা চত্বর রয়ে যায় চিরচেনা রূপে।
বিদেশি বন্ধুরা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে গেলেই দেখা মিলবে দুই ধরনের ব্লক। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক। আন্তর্জাতিক ব্লকে থাকেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা। থাকার জায়গা ভিন্ন হলেও পড়ালেখা, আড্ডা, খেলাধুলা বা সংস্কৃতিচর্চায় কোনো ভেদাভেদ নেই। মিলেমিশেই হয় সব আয়োজন।
এই তো গত পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে, নিজেদের ভাষায় গান ও নাচে অংশ নিয়েছিলেন বিদেশি শিক্ষার্থীরাও। সোমালিয়া থেকে আসা সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশে বাংলাদেশ খুব পরিচিত। বাঙালি সংস্কৃতি আমাদের ভালো লাগে। প্রথম দিকে কিছুটা ভাষাগত সমস্যা হলেও এখন হয় না। এখানকার সবাই খুব আন্তরিক।’
উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে পড়ছেন নেপাল, সোমালিয়া ও শ্রীলঙ্কার প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থী।
পাতার বাঁশির চাচার দোকান
শরীফুল ইসলামের বয়স আশি ছুঁইছুঁই। ক্যাম্পাসের রবীন্দ্র-নজরুল কলা ভবনের সামনে তাঁর ছোট্ট চায়ের দোকান। ২৮ বছর ধরে ক্যাম্পাসে চা বিক্রি করছেন তিনি। দোকানের নাম ‘পাতার বাঁশি চাচার দোকান’। যেকোনো গাছের পাতা দিয়ে অসাধারণ বাঁশি বাজাতে পারেন শরীফুল, সেই থেকে এই নাম।
মনের খেয়ালে বাঁশি বাজালেও চায়ের দোকানের ওপর নির্ভর করেই চলে শরীফুল ইসলামের সংসার। চায়ে চুমুক দিয়ে, পাতার বাঁশি শুনে শিক্ষার্থীরাও ক্লাসের ফাঁকে প্রশান্তি খুঁজে পান। ফলে এখানেও আড্ডাটা ভালোই জমে। আমরা যখন তাঁর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, ঝটপট চা বানানো শেষে জামগাছের পাতায় তিনি সুর তুললেন, ‘আমার গলার হার, খুলে নে ওগো ললিতে।’
ভ্যানই ভরসা
কুষ্টিয়া থেকে ২৪ কিলোমিটার ও ঝিনাইদহ থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে, দুই জেলার সীমান্তে শান্তিডাঙ্গা এলাকায় অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়। দুই জেলার বাসিন্দা শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে অন্তত ৪০টি পরিবহন। পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় না হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই জেলা শহর থেকে এখানে পড়তে আসেন।
প্রতিদিন সকালে সোনা–রোদ্দুর গায়ে মেখে বাসে ক্যাম্পাসে আসেন শিক্ষার্থীরা। আবার দুপুর ও বিকেলে ফেরা। চলে গান, আড্ডা।
ক্যাম্পাসের ভেতরে চলাচলের জন্য রয়েছে প্রায় ১০০টি ভ্যানগাড়ি। মজার বিষয় হলো, মূল ফটক থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের ভেতরে যেখানেই যান না কেন, ভাড়া ৫ টাকা!
আরেক অলরাউন্ডার
কাগজ–কলমে নাম তানিয়া আফরোজ হলেও ক্যাম্পাসে সবাই তাঁকে তমা নামে চেনেন। পড়ার টেবিল কিংবা খেলার মাঠ, দুই জায়গাতেই তমা নিজেকে চিনিয়েছেন। ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এই শিক্ষার্থী নিজ বিভাগের মেধাতালিকায় প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখেন সব সময়। অন্যদিকে খেলাধুলাতেও তাঁর অর্জন কম নয়।
সর্বশেষ অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু আন্তবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপের ব্যাডমিন্টন (একক) প্রতিযোগিতায় ৪৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গোল্ড মেডেল পেয়েছেন তমা। ব্যাডমিন্টনের পাশাপাশি হ্যান্ডবল, ফুটবল, ক্রিকেট, বর্শা নিক্ষেপসহ বিভিন্ন খেলায় রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর।
তমার বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। বলছিলেন, ‘ছোটবেলা থেকে খেলাধুলার শুরু। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেলতাম। স্কুলে আন্তস্কুল ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় খুলনা বিভাগে পরপর দুইবার চ্যাম্পিয়নসহ জাতীয় পর্যায়ে রানারআপ হয়েছিলাম।’ তমা ঢাকার কলাবাগান, ইন্দিরা রোড ক্লাবসহ কয়েকটি ক্লাবে ক্রিকেট খেলেছেন। কুষ্টিয়া জেলা মহিলা ফুটবল দলের অধিনায়কত্বও করেছেন দুইবার। এ ছাড়া জেলা হ্যান্ডবল দলে খেলেছেন। খেলাপাগল তমা ভালোবাসেন গান গাইতে।
এক নজরে
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯৮০
শিক্ষার্থী: প্রায় ১৬ হাজার
শিক্ষক: ৪০৪ জন
অনুষদ: ৮টি
বিভাগ: ৩৪টি
বিদেশি শিক্ষার্থী: ৪০ জন
ওয়েবসাইট: iu.ac.bd