ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ আসেন ঢাকার বাইরে থেকে, তাঁদের অনেকের ঠাঁই হয় ক্যাম্পাসের হলে। জাদুর শহরে নিজেদের নতুন ঠিকানায় থিতু হতে অনেকেই নিজ খরচের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। কেউ টিউশনি করেন, কেউ যুক্ত হন খণ্ডকালীন চাকরিতে। আবার হলের ভেতরেই ছোটখাটো উদ্যোগ নেন কেউ কেউ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের পাঁচটি হলের এমন পাঁচ উদ্যোগের কথা শোনা যাক।
গয়নার বিকিকিনি
মহসিয়া রহমান পড়ছেন চতুর্থ বর্ষে, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম নিয়ে, থাকেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে। ছোটবেলা থেকেই আঁকতে ভালোবাসেন। চেয়েছিলেন চারুকলায় পড়তে, বাবা-মায়ের মতো না থাকায় একরকম বাধ্য হয়েই বিবিএতে ভর্তি হওয়া তাঁর। প্রথম বছর চারুকলায় পড়তে না পারার হতাশায় কেটে গেল, দ্বিতীয় বছরেই ভাবলেন চারুকলা আর ব্যবসা মিলিয়ে কিছু একটা করবেন। বড় বোন, বন্ধুরা আর রুমমেটদের উৎসাহে মাত্র ১০০০ টাকা পুঁজি দিয়ে কাজে লেগে যান। কাপড়ে, কাঠে এঁকে তৈরি করেন গয়না। গত বছরের শেষের দিকে মাত্র এক সপ্তাহের প্রস্তুতিতে হঠাৎ করেই বিভাগের ‘ভয়েজ অব বিজনেস’ নামে একটি আয়োজনে স্টল দেন। এক দিনের মেলায় আয় হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা! উচ্ছ্বসিত গলায় মহসিয়া বলেন, ‘আমি আসলে ভাবতেই পারিনি যে শেষমেশ আমি স্টলটা দিতে পারব বা এ রকম অভূতপূর্ব সাড়া পাব। হলে ১২টার পর লাইট বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু মেলার আগের দুই দিন আমি প্রায় সারা রাত জেগে কাজ করেছি। আমি এঁকেছি, আমার রুমমেটরাও সবাই হাত লাগিয়েছে।’
হলের ভেতর পারলার
অতশী বিশ্বাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাংকিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর করছেন, থাকেন শামসুন নাহার হলে। পড়াশোনার পাশাপাশি ভালো নাচেন, গানেও ভালো। প্রতি সেমিস্টারে একটার পর একটা অনুষ্ঠান লেগেই থাকে, অংশ নিতে হয় অতশীকে। তাই পড়া শেষ করে নিজের সাজগোজ বা মেকআপের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। ‘খুব সুন্দর লাগছে, কোথা থেকে সাজলেন আপু?’ এ রকম প্রশ্নের উত্তরে হেসে ছোট্ট করে বলতেন, ‘নিজে নিজেই সেজেছি।’
এভাবেই হলের মেয়েরা অতশীর কাছে আসা শুরু করেন সাজতে বা শাড়ি পরতে। তৃতীয় বর্ষ থেকে অতশী ঠিক করলেন যখন সময় পান, বিজ্ঞাপন দিয়ে হলের ভেতরেই মেয়েদের সাজানোর কাজ করবেন। অতশীর ভাষায়, ‘বিজ্ঞাপন ছাড়াও খুঁজে খুঁজে অনেকে চলে আসে। শাড়ি পরাই, চুলের খোঁপা করি, চুল স্ট্রেইট করি, মেকআপ করি। নিজের জন্যই অনেক মেকআপ আইটেম কেনা, সেগুলো দিয়ে কাজ চালাই।’ পয়লা বৈশাখ, পয়লা বসন্ত বা ভালোবাসা দিবসের মতো দিনগুলোতে ব্যবসা ভালো হয় বলেও জানান অতশী। হলের পারলার থেকে খরচ কম হওয়ায় ভালোই ‘কাস্টমার’ পান তিনি। প্রতিদিন গড়ে ৪০০-৫০০ টাকা আয় হয় তাঁর। বিশেষ দিবসে এই টাকার অঙ্ক হাজার পেরিয়ে যায়।
হলের ‘ফ্যাশন হাউস’
লোকপ্রশাসনের শারমিন সারা ছোটবেলা থেকেই পোশাক নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসতেন। ফুফুর বাসায় সেলাই মেশিন থাকায় সেখানেই কাটিয়ে দিতেন দিনের বেশির ভাগ সময়। বাধ্য হয়ে মা কিনে দেন সেলাই মেশিন। তাই ছোটবেলা থেকেই একেবারে কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই বিভিন্ন নকশার জামা তৈরি করতেন। সুফিয়া কামাল হলে এসে প্রথম তিনটি বছর পার করেন পড়াশোনা করেই। এর মধ্যে অনেকেই তাঁর পরিহিত পোশাকের প্রশংসা করে, আগ্রহী হয়। হঠাৎ চতুর্থ বর্ষে উঠে তাঁর মনে হয়, তিনি হলের মেয়েদের জন্য অর্ডার নিয়ে তাঁদের পছন্দমতো নকশায় জামা তৈরি করতে পারেন। এমন চিন্তা থেকে প্রথমেই রুমমেটরা তাঁর নকশা করা জামা কিনে উদ্বোধন করেন। এরপর ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
শারমিন বলেন, ‘এমনও দিন গেছে, ১৫-২০টা দল এক দিনে এসে জামা কিনেছে বা অর্ডার দিয়েছে। আমি যখন রুমের বাইরে তখন কোনো ক্রেতা এলে রুমমেটরা জামা বের করে দেখিয়েছে, কাকে কোনটা কেমন মানাবে সাজেশন দিয়েছে, আবার বিক্রি করে টাকা রেখে দিয়েছে। আমি রুমে ফিরলে বুঝিয়ে দিয়েছে।’ এক মাসে সর্বোচ্চ কত টাকার জামা বিক্রি হয়েছে জানতে চাইলে বললেন, ‘প্রায় ত্রিশ হাজার।’
মাস্টার্সে অধ্যয়নরত শারমিন বর্তমানে যাঁরা হাতের কাজ জানেন, তাঁদেরও যুক্ত করেছেন তাঁর এই প্রকল্পের সঙ্গে। ভবিষ্যতে তাঁর এলাকা চুয়াডাঙ্গার গ্রামের নারীদের লোন এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে এর আওতায় আনতে চান তিনি।
পৌঁছে দিই পণ্য
এদিকে মৈত্রী হলের চতুর্থ বর্ষের দুই রুমমেট বুশরা ভুঁইয়া ও সাদিয়া জামান ই-কমার্স সাইট আলি এক্সপ্রেস এবং আমাজন থেকে হলের মেয়েদের বিভিন্ন পণ্য কেনার ব্যবস্থা করে দেন। হলের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর চার্জ ছাড়াও তাঁরা অর্ডার ডেলিভারি দেন। যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি, সম্প্রতি তাঁরা সেগুলোর তালিকা করে নিজেরাই মজুত করে রাখছেন, অর্ডার পাওয়ামাত্র সেগুলো পৌঁছে দিচ্ছেন। প্রতি ডলারে তাঁরা ৪-৫ টাকা লাভ রাখেন। গত ডিসেম্বরে নাকি প্রায় ১২০০ ডলারের পণ্য সরবরাহ করেছেন দুই বন্ধু।
পাঠ সহযোগী
রোকেয়া হলের দ্বিতীয় বর্ষের ফারহানা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ঘ ইউনিট হয়ে বিবিএ পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই অনুধাবন করেছেন। স্কুল, কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার যে বিশাল ফারাক, তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে নতুনদের যে প্রতিনিয়ত অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়, সেটিও তিনি বোঝেন। তাই হলের নতুন মেয়েদের যেন এসব বিষয়ে অসুবিধা না হয়, সে জন্য স্বল্প বেতনে পড়ানো শুরু করেছেন। ভালো সাড়া পাচ্ছেন এবং এই প্রকল্পের বিষয়ে তিনি অত্যন্ত আশাবাদী।