>ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, প্রকৌশল...কত রকম বিষয় আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। কোন বিষয়ে আমি পড়ব, সিদ্ধান্ত নেওয়াই কঠিন। স্বপ্ন নিয়ের এই বিভাগে আমরা একেকটি বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আজ আইন বিভাগ সম্পর্কে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক অর্পিতা শামস মিজান
কী পড়ানো হয়
দেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই অন্যতম চাহিদাসম্পন্ন বিষয় আইন। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কোর্স পড়ানো হয়। তবে সার্বিকভাবে আইন পড়তে হলে কিছু বিষয় একজনকে জানতেই হবে। এর মধ্যে অন্যতম ‘জুরিসপ্রুডেনস’, যা একাধারে আইনের বিজ্ঞান, দর্শন ও ব্যাকরণ। আইনের প্রাথমিক ধারণাগুলো এখানে আলোচনা করা হয়। তা ছাড়া পড়ানো হয় সাংবিধানিক আইন, যা ছাড়া আমরা এ দেশের আইনগুলো বুঝতেই পারব না। বাংলাদেশে পারিবারিক আইনগুলোতে ধর্মীয় আইনের যে গভীর প্রভাব রয়েছে, তা আমরা বুঝি মুসলিম ও হিন্দু আইন পড়তে গেলে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশকে কী কী আইন মেনে চলতে হবে, তা পড়ানো হয় আন্তর্জাতিক আইনে।
তা ছাড়া স্নাতক পর্যায়ে ভূমি আইন, ক্রয়বিক্রয়–সংক্রান্ত আইন, পরিবেশ আইন, ক্রিমিনোলজি, সিপিসি, সিআরপিসি ইত্যাদি সবখানেই পড়ানো হয়। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আরও কিছু বিশেষায়িত বিষয় পড়ানো হয়।
ভবিষ্যৎ কী
আইন খুবই বিস্তৃত বিষয়। তবে এ দেশে পেশাগত ক্ষেত্রে আইনের সঠিক বিকাশ হয়নি বলে মানুষ এখনো কয়েকটি প্রথাগত ক্ষেত্রেই ভবিষ্যৎ গড়ার কথা ভাবে—আদালতে ওকালতি, বিচারক কিংবা শিক্ষক। তবে এর বাইরে আরও অনেক অনেক কাজ সম্ভব। যেমন আইন পড়ে গবেষকও হওয়া যায়। গবেষণা যে শুধু আইনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা নয়। সমাজবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, অর্থনীতি, মেডিকেল সায়েন্স সবকিছুর সঙ্গেই আইন নিয়ে গবেষণা সম্ভব। এ কারণে আইনকে আন্তগবেষণা ক্ষেত্রও বলা যায়। পৃথিবী যতই এগিয়ে যাক না কেন, আইন পেশার গুরুত্ব সব সময় থাকবে।
ক্যারিয়ার কোথায়
প্রথমত, আইনজীবী হিসেবে সফল ক্যারিয়ার গড়ার সম্ভাবনা তো আছেই। কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীরা যেসব চাকরিতে আবেদনের যোগ্য, আইনের শিক্ষার্থীরাও সেই সব পদে অনায়াসে ক্যারিয়ার গড়তে পারেন। ‘জুডিশিয়াল সার্ভিস’ অর্থাৎ সহকারী জজ ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ‘সরকারি ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার’ হওয়ার সুযোগ আছে, যা শুধু আইনের শিক্ষার্থীদের জন্যই। বিসিএসে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস ইত্যাদি নন-টেকনিক্যাল ক্যাডারে যোগ দিতে পারবেন।
দেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শিক্ষকের চাহিদা আছে। কমিশনড অফিসার পদমর্যাদায় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীতে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ‘জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল’ হিসেবে যোগ দেওয়া যায়। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘সহকারী আইনসচিব’ হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার কথাও ভাবতে পারেন।
এ ছাড়া বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি দূতাবাস, ব্যাংক ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ‘ল অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ পাওয়া যায়। আদালতে সরকারি আইন কর্মকর্তা বা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) হিসেবে নিয়োগ হয়। বিদেশে ইমিগ্রেশন কেস অফিসার বা ল অফিসার হিসেবে কাজ করেন অনেকে। আইনের ডিগ্রিধারীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা—যেমন ইউএনএইচসিআর, ইউএনডিপি, ডব্লিউএইচও, ইউনিসেফ, আইওএম, আইএলও ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ। আইনি পরামর্শক বা উপদেষ্টা হিসেবেও ক্যারিয়ার গড়তে পারেন। তা ছাড়া মানবাধিকার কিংবা নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে যদি কেউ কাজ করতে চান, তবে তাঁর জন্য সেরা প্ল্যাটফর্ম আইনপাঠ।
কেউ যদি একটু ব্যতিক্রম কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে চান, চলচ্চিত্রশিল্পে আইন পরামর্শক বা কোর্টরুম–বিষয়ক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকারও হতে পারেন। আইনের বিষয়গুলো গল্পচ্ছলে লিখে হতে পারেন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জন গ্রিশামের মতো লেখকও।
কারা পড়বেন
বিষয়টা যখন আইন তখন অন্তত এই প্রশ্ন করা উচিত নয় যে কারা পড়বে। আইনপাঠ সবার জন্য জরুরি। অতএব উত্তর একটাই—আইন সবাই পড়বে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়বেন? এ ক্ষেত্রে দুটো ভাগ করা যায়। প্রথমত, গবেষণার প্রবৃত্তি যাঁদের আছে। আইনের শাসন আছে কি না, আইনগুলো সমাজের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে কি না—এসব নিয়ে যাঁরা চিন্তাভাবনা করতে ভালোবাসেন, তাঁরাই আইন পড়বেন। আর দ্বিতীয়ত, যাঁরা পেশাগত জীবনে বিচারক বা আইনজীবী হতে ইচ্ছুক।
তবে একজন ছাত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার যা আইন পড়তে সাহায্য করবে। গভীরভাবে চিন্তা করতে পারা তার মধ্যে অন্যতম। আইন কখনোই মুখস্থের বিষয় নয়। অনেকের ভুল ধারণা যে আইনের ধারা জানা মানেই আইন জানা। যা মোটেও সত্য নয়। আইন পড়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে একটা বিষয়কে বিশ্লেষণ করতে পারা। গভীর চিন্তাশক্তি এ ক্ষেত্রে খুব জরুরি। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, বিজ্ঞান বা ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্রছাত্রীরা আইন কেন পড়বেন? আসলে আইন একটি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি বিষয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনের অনেক বিষয় ব্যবসায় শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত—চুক্তি আইন, ব্যবসায়িক আইন, প্রাতিষ্ঠানিক আইন যার মধ্যে অন্যতম। ঠিক তেমনি সম্পর্ক আছে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর সঙ্গে। এনার্জি ল কিংবা ফরেনসিক ল তো তাঁদেরই জন্য, যাঁরা একসময় পদার্থবিজ্ঞান কিংবা জীববিজ্ঞান পড়তে ভালোবাসতেন।