‘শুরুতে আমাদের পরিকল্পনাটা নিয়ে আমরা একটা বিজনেস কেস কম্পিটিশনে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে আমাদের বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। আমরা ভাবতে শুরু করি, আমাদের পরিকল্পনার কোথায় ভুল ছিল। সব ভুলচুক বের করে, সবকিছু গুছিয়ে নিতে ছয় মাস লেগে যায়। তারপর কাজ শুরু করি। এখন তো জ্ঞানজ্যামের বয়স এক বছর পেরিয়ে গেছে।’ বলছিলেন মো. লতিফুর রহমান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের ছাত্র তিনি। তাঁর সঙ্গে আছেন তৃতীয় বর্ষের সুমাইয়া শারমিন (যন্ত্রকৌশল) ও নুসরাত বিনতে নিজাম (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং)। তাঁরা তিনজন মিলেই শুরু করেছিলেন এই ‘জ্ঞানজ্যাম’।
‘জ্ঞানজ্যাম আসলে কী?’
প্রশ্ন করতে সুমাইয়া এক আঙুল তুলে লতিফুরের টি–শার্টটা দেখিয়ে দিলেন। জ্ঞানজ্যামেরই টি–শার্ট। সেখানে লেখা আছে, ‘জাস্ট আ ড্রিম’। তিন তরুণ মিলে একটি স্বপ্ন নিয়ে শুরু করেছিলেন জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ—জ্ঞানজ্যাম।
‘আমরা চাই, বাংলাদেশের প্রতিটি তরুণ-তরুণী স্বাবলম্বী হোক, টেকনোলজির ব্যবহার জানুক সবাই, জিনিসটা এমন আহামরি কঠিন কিছুও নয়। খুব বেশি দিন আগের কথা না, চীন আমাদের বাংলাদেশের মতোই ছিল। কিন্তু প্রযুক্তি ব্যবহারের অসাধারণ ক্ষমতা তাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেক দূর’, নুসরাত যখন জ্ঞানজ্যামের স্বপ্নটা আরেকটু ভেঙে বললেন, তখন প্রশ্নটা মাথায় আসে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কীভাবে কাজ করছেন তাঁরা? ‘আমাদের চারপাশে অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা টেকনোলজি–সম্পর্কিত জ্ঞানগুলো ছড়িয়ে দিতে চান এবং তার বহুগুণ মানুষ আছেন যাঁরা টেকনোলজি–সম্পর্কিত জিনিসগুলো শিখতে চান। কিন্তু কোথায় যেন একটা জ্যাম লেগে আছে। তাঁদের একজন আরেকজনের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। আমরা দুই ধরনের মানুষদেরই একজনের কাছে আরেকজনকে নিয়ে আসছি, জ্ঞানের এই জ্যামটা দূর করাটাই আমাদের একদম প্রাথমিক উদ্দেশ্য। যারা শিখতে চায় তারা যেন শিখতে পারে, সেই ব্যাপারটা নিশ্চিত করতেই আমরা স্কুল-কলেজগুলোতে কর্মশালা করছি নিয়মিত।’
ঢাকার স্বনামধন্য বেশ কয়েকটি কলেজে শিক্ষার্থীদের টেক-জ্ঞান বাড়ানোর জন্য কর্মশালা করেছেন জ্ঞানজ্যামের এই তরুণেরা। কর্মশালায় বেসিক রোবোটিকস ওয়ার্কশপ, প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট, আরডুইনো, সি প্রোগ্রামিং, সলিডওয়ার্কস—প্রকৌশলবিদ্যার ব্যবহারিক নানা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শেখানো হয়। হলিক্রস কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, সেন্ট জোসেফ কলেজ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ, লালমাটিয়া মহিলা কলেজে তাদের কর্মশালা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সামনে আরও বেশ কয়েকটি কলেজে কর্মশালা আয়োজনের পরিকল্পনা আছে। শুধু কলেজ নয়, খুলনার পাঁচটি স্কুলে একসঙ্গে তাঁরা কর্মশালা করেছেন।
কেমন সাড়া পেয়েছিলেন? ‘আমাদের প্রথম কর্মশালাটা হয়েছিল ২০১৭ সালের একদম শুরুতে, মতিঝিল আইডিয়াল কলেজে। প্রথম ওয়ার্কশপ, কী বলব না বলব ভেবে নার্ভাস ছিলাম, ভেবেছিলাম মানুষও হয়তো বেশি হবে না। কিন্তু নির্ধারিত রুমটাতে ঢুকে তো আমি অবাক! সামনে প্রায় এক হাজার ছাত্রছাত্রী বসে ছিল। একদম ক্লাস থ্রি-ফোরের বাচ্চা থেকে শুরু করে কলেজপড়ুয়ারাও। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একদম ছোট বাচ্চাদেরও কত প্রশ্ন! কী যে খুশি লাগছিল, খুশিতেই সব দ্বিধা-ভয় দূর হয়ে গেল। প্রথম কর্মশালা থেকেই আমরা বেশ ভালো সাড়া পেয়ে এসেছি।’
কীভাবে চলে এই জ্ঞানজ্যাম? লতিফুর যা জানালেন তাতে অবাকই হতে হয়, ‘বিভিন্ন স্কুলে স্কুলে যে কর্মশালাগুলো আমরা আয়োজন করি তাতে আমাদের বেশ টাকাপয়সা খরচ হয়। কিন্তু আয় খুব সীমিত। আমরা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ সরবরাহ বা তৈরির কাজ করি। এর মাধ্যমে কিছু আয় হয়। জ্ঞানজ্যাম চালানোর জন্য আসলে আমাদের টিউশনির ওপরই নির্ভর করতে হয়।’
জানা গেল, লতিফুর, নুসরাত আর সুমাইয়া—তিনজন মিলে মোট সাতটি টিউশনি করেন। প্রতিদিন সকালে তাঁদের নিজেদের ক্লাস করতে হয়, ক্লাস শেষে এসে নিজেরা টিউশনি করেন, তারপর শুরু হয় জ্ঞানজ্যামের কাজ। কর্মশালার প্রস্তুতি নিতে হয়, আবার নিজেদের পড়ালেখা তো আছেই। সব মিলিয়ে খুব ব্যস্ত সময় কাটছে এই তরুণদের।
স্বপ্নটা অনেক বড় বলেই এই কষ্ট গায়ে মাখেন না লতিফুর, নুসরাত ও সুমাইয়া। ‘আমরা চাই, বাংলাদেশে একদিন ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থাকবে, বাইরে থেকে আমদানি করতে হবে।’ বলছিলেন নুসরাত। এই জ্ঞানজ্যাম সেই স্বপ্নের ভবিষ্যতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে? সুমাইয়া বলেন, ‘আমরা একটা স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছি, তা বাস্তবায়নে যতটা সম্ভব চেষ্টা এবং কষ্ট করে যাচ্ছি। আমাদের ইচ্ছা আছে বাংলাদেশের সব জেলার সব স্কুলে জ্ঞানজ্যামের একটা করে কর্মশালার আয়োজন করব। মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায় বাইরের অনেক দেশের বাচ্চারা প্রযুক্তি–সংক্রান্ত অনেক কিছু করে ফেলছে। বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুও যেন অমনটা পারে, সেটার জন্যই আমাদের এই খাটুনি। এই কাজ আমরা শেষ করতে চাই আগামী দশ বছরের মধ্যে। আমাদের আরও অনেক পরিকল্পনা আছে সামনে। আপাতত এটুকু তো আগে বাস্তবায়ন হোক...।’