জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেছেন, আমরা বিদেশি সাহায্যের ওপর তেমন নির্ভরশীল নই। আমাদের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। এটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। আজ শনিবার সিলেটে এনবিআর ও সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির উদ্যোগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ওপর প্রাক্-বাজেট আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, জাতীয় বাজেটের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ খাত থেকেই আসে। বর্তমানে আয়কর ৩৭ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কর আদায়ের উন্নত একটি মাধ্যম হলো অগ্রিম আয়কর। তবে সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অগ্রিম আয়কর কমানোর চেষ্টা করবে।
অনুষ্ঠানে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আগামী এক মাসের মধ্যে তামাবিল স্থলবন্দরে ব্যাংকের বুথ চালু এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ শুরু করার বিষয়টি জানান এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, পর্যটকদের ভ্রমণ কর বাতিলের বিষয়টি বিবেচনা, অগ্রিম আয়কর ও রেজিস্ট্রেশন ফি কমিয়ে আনা এবং ভ্যাট নিবন্ধন এক দিনের মধ্যেই দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিলেটের একটি রেস্তোরাঁয় আয়োজিত ওই আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন সিলেট চেম্বারের সভাপতি খন্দকার সিপার আহমদ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সিলেটের কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনার গোলাম মো. মুনীর, কর অঞ্চল-সিলেটের কর কমিশনার রনজীত কুমার সাহা, এনবিআর সদস্য (কাস্টমস নীতি) মো. ফিরোজ শাহ্ আলম, সদস্য (ভ্যাটনীতি) আবদুল মান্নান শিকদার, সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মৃণাল কান্তি দেব, সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার পরিতোষ ঘোষ ও সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) মো. আসলাম উদ্দিন।
সিলেট চেম্বারের পক্ষ থেকে সভাপতি খন্দকার সিপার আহমদ আসন্ন বাজেটে বিবেচনা করার জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে করের বোঝা না বাড়িয়ে আওতা বাড়ানো, তামাবিল স্থলবন্দরে ব্যাংকের বুথ স্থাপন, স্থলপথে পর্যটকদের ভ্রমণ কর বাতিল, প্যাকেজ ভ্যাট চালু রাখা, ফল আমদানির বাধা অপসারণ, শেওলা বন্দর দিয়ে সব ধরনের পণ্য আমদানি-রপ্তানি, অগ্রিম শুল্ক বিধান বাতিল, পর্যটনের বিকাশে হোটেল-রিসোর্টগুলোকে ১০ বছরের কর অবকাশ প্রদান, স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নতুন শিল্প স্থাপনে কর অবকাশ প্রদান। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ে ব্যবসায়ীরা ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।
মুক্ত আলোচনায় বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীরা তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। এর মধ্যে বিসিক শিল্পনগরীতে প্লট হস্তান্তরের ওপর ধার্য ফি থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার, ইকোনমিক জোনের মতো সুযোগ-সুবিধা প্রদান, কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর সব পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি, কয়লা আমদানির ক্ষেত্রে এলসি কমিশনের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার, নিজেদের সম্পত্তি হস্তান্তর সহজীকরণ, প্যাকেজ ভ্যাট চালু রাখা, হাইটেক পার্কের যন্ত্রাংশ ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ওপর সব কর প্রত্যাহার, সুনামগঞ্জের ডলুরা ও বাঁশতলা শুল্ক স্টেশন চালু, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ইকোনমিক জোন ও বিসিক শিল্প এলাকায় প্লট বরাদ্দ, রেলওয়ে খাতে সিলেটের জন্য আলাদা বরাদ্দ প্রদান, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো টার্মিনাল ও স্ক্যানিং মেশিন স্থাপন করে পণ্য রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি, শুল্ক স্টেশনগুলোতে আমদানি-রপ্তানিকারকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেন।
মুক্ত আলোচনা পর্ব সঞ্চালনা করেন সিলেট চেম্বারের সহসভাপতি মো. এমদাদ হোসেন। বিভিন্ন প্রস্তাব উপস্থাপন করে বক্তব্য সিলেট চেম্বারের পরিচালক এবং ভ্যাট, বাজেট, শুল্ক, কর ও ট্যারিফ সাব কমিটির আহ্বায়ক মো. হিজকিল গুলজার, পরিচালক পিন্টু চক্রবর্তী, কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি চন্দন সাহা ও মো. আতিক হোসেন, সিএনজি ফিলিং স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, ভোলাগঞ্জ পাথর আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি মুজিবুর রহমান, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মো. বশিরুল হক, হবিগঞ্জ চেম্বারের পরিচালক শেখ আনিসুজ্জামান, গণদাবী পরিষদের সভাপতি চৌধুরী আতাউর রহমান আজাদ, উইমেন্স চেম্বারের সভাপতি স্বর্ণলতা রায়, সুনামগঞ্জ চেম্বারের পরিচালক নুরুল ইসলাম, সিলেট কর আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. আবুল ফজল, সাধারণ সম্পাদক আবদুল আলীম পাঠান, ফল ও কাঁচামাল আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি মো. আবুল কালাম ও সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা চৌধুরী, বিসিক শিল্প মালিক সমিতি গোটাটিকরের সাধারণ সম্পাদক আলীমুল এহছান চৌধুরী, রড সিমেন্ট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মজনু মিয়া, সিলেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জিয়াউল হক, সিলেট চেম্বারের পরিচালক ফালাহ উদ্দিন আলী আহমদ প্রমুখ।
প্রাক্-বাজেট আলোচনায় প্রস্তাব, বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের দাবি প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আমরা সবার পরামর্শ বিবেচনা করে আগামী বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করব। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, সবার অংশগ্রহণে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র থেকে বড় শিল্পের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থান। কিন্তু কর আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা এখনো সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারিনি। যে কারণে প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে মাত্র ২০ লাখ লোক আয়কর রিটার্ন জমা দেন। বিদেশে এই বিষয়টি এত সুসংগঠিত যে কর জালের বাইরে কেউ যেতে পারে না। এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এবং করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান সভায় আরও জানান, ইএফডি মেশিনের টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। সেন্ট্রাল সার্ভারের সঙ্গে সংযুক্ত করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে সেটা বিতরণ করা হবে। এর মাধ্যমে জানা যাবে কোথায় কোথায় ভ্যাট আদায় হচ্ছে। তিনি বলেন, ১৫ শতাংশ ভ্যাট থেকে বেরিয়ে এসে আমরা কয়েকটি ধাপ করে দেব। এর ফলে ছোট হারেও ভ্যাট আদায় করলে ভ্যাটের হার ও আওতা অনেক বাড়বে।