দেশি ফলেরই বেশি দাপট
>
- ফলের বাজার
- বাড়তে থাকা বিদেশি ফলের আমদানি এ অর্থবছরে কমতে শুরু করেছে
- বিদেশি আপেলের বাজারে ভাগ বসিয়েছে দেশে উৎপাদিত থাই পেয়ারা
ফলের বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য বিদেশি আপেলের। প্রতিবছর গড়ে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছিল বিদেশি এই ফলের আমদানি। গত অর্থবছরেও প্রতিদিন গড়ে ৭ লাখ কেজি আপেল বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে। তবে এ অর্থবছরে আপেল আমদানি কমে নেমেছে দিনে ৫ লাখ কেজিতে।
গত অর্থবছরে ২ লাখ ৫৭ হাজার টন আপেল আমদানি হয়। প্রতি টন ১ হাজার কেজি হিসেবে তা দাঁড়ায় ২৫ কোটি ৭০ লাখ কেজি। তাতে ১ হাজার ৮০ কোটি টাকার সমমানের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। শুল্ককর পরিশোধ করে এই আপেল খুচরা ক্রেতাদের হাতে পৌঁছায়। খুচরা বাজারদর হিসাব করে দেখা যায়, শুধু আপেলের বাজারই ৩ হাজার ৮৬০ কোটি টাকার।
বিদেশি আপেলের এই বড় বাজারে ভাগ বসিয়েছে দেশে উৎপাদিত থাই জাতের পেয়ারা। আপেলের চেয়ে দাম কম এবং রাসায়নিকমুক্ত হওয়ায় আপেলের বদলে মানুষ এখন এই পেয়ারা বেছে নিচ্ছেন। আর তাতেই আপেল আমদানি কমে যাচ্ছে বলে কৃষিবিদেরা জানিয়েছেন। আপেলের মতো নাশপাতি ও বিভিন্ন ধরনের সাইট্রাস বা লেবুজাতীয় ফলের আমদানিও কমেছে।
দেশে নতুন নতুন জাতের আম, মাল্টা, কমলা, ড্রাগন ফলসহ বিদেশি জাতের ফলের আবাদ হচ্ছে। একসময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিদেশি ফলের ওপর নির্ভরতা ছিল। এখন এই সময়ে দেশীয় ফলের সরবরাহ বাড়ছে। তাজা ও রাসায়নিকমুক্ত ফলে আগ্রহ বাড়ছে মানুষের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে দেশে ফলের উৎপাদন বেড়েছে ২১ লাখ কেজি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ফল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৯৯ লাখ ৭২ হাজার কেজি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে গত অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ২১ লাখ কেজিতে। এই অর্থবছর শেষেও ফল উৎপাদন আরও বাড়বে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।
এত দিন ফল উৎপাদন বাড়লেও বিদেশি ফলের আমদানি কমেনি। কারণ হিসেবে কৃষিবিদেরা বলছেন, দেশে গ্রীষ্ম ও বর্ষা ছিল ফল উৎপাদনের ভরা মৌসুম। সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসে ফলের উৎপাদন বা সরবরাহ ছিল কম। তাই এই সময়টাতে মানুষকে বাধ্য হয়ে বিদেশি ফল কিনতে হতো। তবে সময় পাল্টেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের প্রকল্প হাতে নিয়ে এই সময়টাতেও ফলের আবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিদেশি ফল বেচাকেনার ভরা মৌসুমেও এখন পাওয়া যাচ্ছে দেশি ফল। এর মধ্যে প্রধান ফল হলো নতুন নতুন জাতের পেয়ারা।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, ২০০৫–০৬ অর্থবছরে থাইল্যান্ডের চিয়াংমাই অঞ্চল থেকে এই জাতের চারা নিয়ে আসেন কৃষিবিদ এস এম কামরুজ্জামান। প্রথমে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে নাটোরের ঝাউতলা ফুলবাড়ী এলাকায় এই পেয়ারার চাষ শুরু করেন। ফলন ও দাম ভালো পাওয়ায় এই পেয়ারার চাষ দ্রুত বাড়তে থাকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩–১৪ অর্থবছরে দেশে পেয়ারার উৎপাদন হয় ৩ লাখ টন। গত অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ৫ লাখ ৬ হাজার টনে। পেয়ারার উৎপাদন দ্রুত বাড়ার কারণ হচ্ছে থাইসহ নতুন জাতের পেয়ারার আবাদ বাড়া। দেশে উৎপাদিত পেয়ারার ৭০ শতাংশই থাই জাতের। শুরুতে দাম বেশি থাকলেও ফলন বাড়ায় এখন এর দাম আপেলের চেয়ে কম। নিরাপদ হওয়ায় মানুষের পছন্দ হয়ে উঠেছে পেয়ারার এই জাত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘সারা বছরব্যাপী ফল উৎপাদন ও পুষ্টি উন্নয়ন’ প্রকল্পের পরামর্শক এস এম কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, থাই জাতের পেয়ারা গাছে থাকা অবস্থায় পলিথিন মুড়িয়ে রাখা হয়। ফলে কীটনাশক দিতে হয় না, রাসায়নিকও ব্যবহার করতে হয় না। ফলে এই জাতের পেয়ারার প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। দেশে এখন যেভাবে বারোমাসি আম, মাল্টা, কমলা, ড্রাগনসহ বিদেশি ফলের চাষ শুরু হচ্ছে, তাতে তিন–চার বছরের ব্যবধানে আপেল, কমলা, নাশপাতি ও মাল্টার মতো বিদেশি ফলের আমদানিও কমবে বলে মনে করেন কামরুজ্জামান।
বিদেশি ফলের আমদানি কমার তথ্য আছে চট্টগ্রাম কাস্টমসের হিসাবে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে আপেল, নাশপাতি, কমলা, মাল্টা ও আঙুর—এই পাঁচটি প্রধান ফল আমদানি হয় ২ লাখ ৮২ হাজার টন। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৫২ হাজার টনে। আমদানি কমায় আট মাসেই গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯৯ কোটি টাকার সমমানের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ফল আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ২৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা ২ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় হয়েছে ২৯ কোটি ডলার বা প্রায় ২ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, দেশে ফলের উৎপাদন ও বৈচিত্র্য বাড়ছে। চাহিদানুযায়ী দেশি ফলের উৎপাদন হলে বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় করে ফল আমদানি করতে হবে না।