>নির্বাচনের পর কিছুদিন চাঙাভাবের পর আবারও দরপতন চলছে শেয়ারবাজারে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আবারও আস্থাহীনতা। নানা অনিয়ম ও কারসাজির ঘটনা ঘটলেও শাস্তির আওতায় আসছেন না কারসাজিকারকেরা। ভালো কোম্পানির বদলে বাজারে আসছে মানহীন কোম্পানি। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এসব নিয়ে কথা বলেছেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মসলিন ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়ালি–উল–মারুফ মতিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজয় মহাজন।
প্রথম আলো: শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? বাজার কি স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল আচরণ করছে?
ওয়ালি–উল–মারুফ মতিন: গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শেয়ারবাজারের যেসব সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, তা এখনো রয়ে গেছে। সেসব সমস্যার উন্নতি হয়নি। ফলে বাজারের ভালো-মন্দ এখনো বিবেচনা করা হয় সূচকের উত্থান-পতন দিয়ে। সূচক ঊর্ধ্বমুখী মানেই বাজার ভালো আর সূচক নিম্নমুখী হওয়া মানেই বাজার খারাপ। এ কারণে বাজারে দাম বাড়লে সরকার থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বিনিয়োগকারী সবাই খুব খুশি থাকে। কিন্তু টানা উত্থান ও টানা পতনের মধ্যে যে অস্বাভাবিকতা থাকে সেটা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। বাজারের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে আমার কাছে বড় বিবেচ্য কতগুলো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলো, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধনের অবস্থান কী? সেই বিবেচনায় বলা যায় বাজার ভালো অবস্থায় নেই। তা ছাড়া বাজারের যে সার্ভেল্যান্স ব্যবস্থা সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারী কারোরই আস্থা নেই। এ আস্থাহীনতা রেখে বাজার স্থিতিশীল বা ভালো হবে, এমন কিছু আশা করা যায় না।
প্রথম আলো: তার মানে কি নিয়ন্ত্রণ দুর্বলতার কারণেই বাজারের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে?
ওয়ালি–উল–মারুফ মতিন: আস্থাহীনতার অনেক কারণ রয়েছে। তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ দুর্বলতা তার মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশে শেয়ারবাজার বলতেই আমরা বুঝি ইক্যুইটিনির্ভর বাজার। বিনিয়োগের জন্য এখানে পর্যাপ্ত পণ্য নেই। দশকের পর দশক বাজারে পণ্যবৈচিত্র্য বাড়ানোর কথা বলা হলেও সেটি এখনো হয়নি। আমি মনে করি, যত দিন বাজার শুধু ইক্যুইটিনির্ভর থাকবে তত দিন বাজারে কারসাজি বলি আর অশুভ আচরণ বলি তা থাকবেই। আমাদের বাজারের বড় দুর্বলতা এখানে বিনিয়োগকারী, বাজার মধ্যস্থতাকারী, তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির ভেতরে কী হচ্ছে, তা কোনোভাবেই জানতে পারছে না। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো সম্পর্কে আমরা ততটুকুই জানতে পারি, যা আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে কোম্পানিটি স্বেচ্ছায় জানায়। আবার তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে যেসব স্বতন্ত্র পরিচালক রয়েছেন, তাঁরাও তাঁদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করছেন না। ফলে পারস্পরিক আস্থাহীনতা দূর হচ্ছে না।
প্রথম আলো: স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার তো আইনি ক্ষমতা আছে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ওপর তদারকি বাড়ানোর। সেটি কি যথাযথভাবে হচ্ছে?
ওয়ালি–উল–মারুফ মতিন: আমি বলব, এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। আইনগত সুযোগ থাকলেও তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়মিত কোনো তদারকি নেই। এ কারণে কোনো কোম্পানি কার্যক্রম গুটিয়ে নিলে বা কারও কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে সেটি যতক্ষণ ওই কোম্পানি না জানাচ্ছে, ততক্ষণ কেউই জানতে পারছে না। এ কারণে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন খাতের কোম্পানি নিয়ে যেসব অ্যানালাইসিস হচ্ছে, তা কাগজপত্রের ভিত্তিতে গতানুগতিকভাবে। যার মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য পাওয়ার বা জানার কোনো সুযোগ নেই। বাজারের স্থিতিশীলতা আনতে হলে সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। সুশাসন না থাকলে যত কিছুই করা হোক, তাতে কোনো ফল আসবে না।
প্রথম আলো: বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় আইন করে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিধান করা হয়েছে। তারপরও কেন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত হচ্ছে না।
ওয়ালি–উল–মারুফ মতিন: তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ ও তাঁদের যোগ্যতা কী হবে, তার নীতিমালা আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বর্তমানে স্বতন্ত্র পরিচালক হওয়ার অন্যতম যোগ্যতা হচ্ছে কোম্পানির চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বন্ধু ও আত্মীয় হওয়া। এ কারণে স্বতন্ত্র পরিচালকের পদগুলো অনেকটা আলংকারিক হয়ে গেছে। স্টক এক্সচেঞ্জে প্রায় ৩০০-এর মতো কোম্পানি আছে। একেকটি কোম্পানিতে দুজন করেও যদি স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করতে হয় তাহলে ৬০০ জন পরিচালক দরকার। পরিচালক হওয়ার মতো যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন এত লোক কি আদৌ আছে? দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জেই এখন স্বতন্ত্র পরিচালকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তাতে কি স্টক এক্সচেঞ্জগুলোতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন এসেছে? স্টক এক্সচেঞ্জের পর্ষদে এমন অনেক স্বতন্ত্র পরিচালক রয়েছেন, যাঁদের বাজার সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তাহলে তাঁরা কীভাবে বাজারের উন্নয়নে কাজ করবেন? এর ফলে যেটা দাঁড়িয়েছে, তা হলো যিনি যে বিষয়ে কিছু জানেন না বা বোঝেন না তাঁকে দিয়েই সেই কাজ করানো হচ্ছে। ফলে গুণগত কোনো পরিবর্তন ঘটছে না।
প্রথম আলো: এখন আমি যদি জানতে চাই স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশনের সুফল কি আদৌ মিলছে? কী বলবেন?
ওয়ালি–উল–মারুফ মতিন: এ ক্ষেত্রে প্রথম কথা হচ্ছে ডিমিউচুয়ালাইজেশন এখনো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। ডিমিউচুয়ালাইজেশন বলতে যা বোঝায়, তা এখনো হয়নি। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের নামে এখন যা হয়েছে, তা হলো স্টক এক্সচেঞ্জের পর্ষদে কিছু পরিবর্তন, কোম্পানির বাণিজ্যিকীকরণ আর স্টক এক্সচেঞ্জের কিছু শেয়ার বিক্রি। তা–ও হয়েছে একটি স্টক এক্সচেঞ্জের। ডিমিউচুয়ালাইজেশন স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের সঙ্গে পেশাদার লোকজনের যুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা থাকে। সেটি আমাদের দেশে এখনো নিশ্চিত হয়নি।
প্রথম আলো: বর্তমান বাজারে সাদাচোখে দেখলেও কিছু অনিয়ম ও কারসাজির ঘটনা দেখা যায়। কারসাজি বন্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কি যথাযথ ভূমিকা রাখছে?
ওয়ালি–উল–মারুফ মতিন: আমরা যে সমাজের মধ্যে আছি, সেখানে আইন না মানাই আইন হয়ে গেছে। কারসাজি বন্ধে অনেক আইন আছে। কিন্তু আমরা সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ দেখছি না। ফলে কারসাজিকারকেরা উৎসাহিত হন। অনেক সময় আমরা দেখতে পাচ্ছি অনিয়মের কারণে যাঁর শাস্তি পাওয়ার কথা উল্টো তিনি পুরস্কৃত হচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আমাদের বাজারে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত কিছু কোম্পানি আছে। যার অনেকগুলোরই কার্যক্রম বন্ধ। যুগের পর যুগ এসব কোম্পানির লেনদেন হচ্ছে, যেসব কোম্পানির কোনো ভিত্তিই নেই। বলা হয়, বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হবে এ জন্য এসব কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করা হয় না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এসব বাজে কোম্পানিকে বাজারে রেখে আদৌ কি বিনিয়োগকারীদের লাভ হচ্ছে কোনো। বাজারে খারাপ কোম্পানির সংখ্যা বেশি থাকলে ভালো কোনো কোম্পানি সেখানে আসতে তো আগ্রহ দেখাবে না, এটাই স্বাভাবিক। এ রকম সুশাসনের অভাবের অসংখ্য নজির রয়েছে বাজারে। যেভাবে বর্তমানে বাজারে নতুন কোম্পানি বাজারে আসছে সেটিও সুস্থকর কোনো ব্যবস্থা নয়। মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় দাম নির্ধারণ হচ্ছে বন্ধ ঘরে। ফলে বুক বিল্ডিং পদ্ধতি নিয়েও কারসাজির ঘটনা ঘটছে। দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অধিকসংখ্যক প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারীদেরও যুক্ত করা দরকার। আবার ভালো কোম্পানির জন্য তেমন কোনো প্রণোদনা নেই। এ কারণে ভালো কোম্পানিকে বাজারে আনা সম্ভব হচ্ছে না।