ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ
>• জাহাজ নির্মাণশিল্প রক্ষায় দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংকঋণ পরিশোধের সুযোগ করে দিয়েছে সরকার
• ঋণের সুদের ওপর ৪ শতাংশ হারে ভর্তুকি দেওয়া হবে
• ১০ বছর মেয়াদে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়
ইউরোপের আর্থিক সংকটের কারণে বিশ্বজুড়ে জাহাজ নির্মাণশিল্পে মন্দা শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে। একটানা পাঁচ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে স্থবির হয়ে পড়েছিল এ খাত। ২০১৭ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে মন্দা কাটতে শুরু করলেও বাংলাদেশে রপ্তানি খাতে গতি ফেরেনি। এর বড় কারণ ঋণের জালে আটকে পড়েছিল দেশীয় রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো। ঠিক এমন সময়ে আটকে থাকা ঋণ দীর্ঘ মেয়াদে পরিশোধের সুযোগ দিয়ে এ খাতকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের হিসাবে, গত বছরের জুন পর্যন্ত ২৭টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জাহাজ নির্মাণশিল্পের অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ঋণের স্থিতি ছিল প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এই ঋণ পরিশোধের চাপে জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন কার্যাদেশ নিতেও হিমশিম খাচ্ছিল। দেশে ব্যবহারের ছোট জাহাজ নির্মাণ করে এবং কর্মী ছাঁটাই করে খরচ কমিয়েও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি প্রতিষ্ঠানগুলো।
এ শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য সুখবর হয়ে আসে সরকারি নীতি ও আর্থিক সহায়তা। তিন বছর কোনো ডাউনপেমেন্ট পরিশোধ ছাড়া এবং ১০ বছর মেয়াদে (ত্রৈমাসিক কিস্তিতে) ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে অর্থ মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নেয়। গত ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সব তফসিলি ব্যাংককে এ সিদ্ধান্ত অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। গত জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ধাপে ধাপে বেশির ভাগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে। আবার এ খাতে নেওয়া ঋণের সুদের ওপর ৪ শতাংশ হারে ভর্তুকি দেওয়ারও নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। সুদের ওপর ভর্তুকি প্রদান কার্যকর হলে এই শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করেন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশের আগে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জাহাজ নির্মাণশিল্প সুরক্ষা দিতে নানা পদক্ষেপ নেয়। যেমন ভারত সরকার ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত জাহাজের রপ্তানি মূল্যের ওপর ২০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা অনুমোদন করেছে। চীনের উদ্যোক্তারা স্বল্প সুদে ঋণের পাশাপাশি নিজেদের কাঁচামাল ব্যবহারে ভর্তুকি পাচ্ছে। মন্দা থেকে এই ভারী শিল্প খাতকে সুরক্ষা দিতে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয় দেশগুলোতে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক খবিরুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি উদ্যোগ খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে নীতি সহায়তার পাশাপাশি জাহাজ নির্মাণশিল্পকে এগিয়ে নিতে আলাদা সংস্থা গঠন করা উচিত। তাহলে এই খাতের সমস্যা সময়মতো গুরুত্ব দিয়ে দেখা সম্ভব হবে। এখন হয়তো এক-দুটি প্রতিষ্ঠান রপ্তানি করছে। জাহাজ নির্মাণে সক্ষমতা থাকার পরও এই খাত যেন এক-দুটি প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ না থাকে, সেটি দেখতে হবে।
জাহাজ নির্মাণ খাতের সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশে এমন সময়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যখন বৈশ্বিক জাহাজ নির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের রিভিউ অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্টের ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, একটানা পাঁচ বছর শ্লথগতির পর ২০১৭ সালে জাহাজ নির্মাণশিল্পে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে গ্যাস পরিবহনকারী জাহাজে। বিশেষায়িত এই জাহাজের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের বেশি। প্রবৃদ্ধিতে এর পরেই রয়েছে জ্বালানি তেল পরিবহনকারী জাহাজ।
জাহাজ নির্মাণে মান তদারককারী সংস্থা ফ্রান্সভিত্তিক ব্যুরো ভেরিতাসের বাংলাদেশের প্রধান কর্মকর্তা মো. হারুনর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, মন্দার পর ২০১৭ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে জাহাজ নির্মাণশিল্পে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশের (এইওএসআইবি) তথ্যানুযায়ী, দেশে রপ্তানিযোগ্য জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০টি। গত ১০ বছরে ১৭ কোটি ডলারের ৪০টি জাহাজ রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে ১১ কোটি ডলারের জাহাজ রপ্তানি হয় মন্দার আগে। বিশ্বের ১২টি দেশে এসব জাহাজ রপ্তানি করেছে তারা।
উত্থান-পতন
এ খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে জাহাজ রপ্তানি শুরু হয় ২০০৮ সালে। ঢাকার আনন্দ শিপইয়ার্ড ডেনমার্কে এমভি স্টেলা মরিস নামের ছোট আকারের একটি জাহাজ রপ্তানি করে। এর পরেই যুক্ত হয় চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। তারা জার্মানির গ্রোনা শিপিং কোম্পানির কাছ থেকে ৮৫ মিলিয়ন ডলারের আটটি জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশ পায়। এ দুটি প্রতিষ্ঠান যখন জাহাজ রপ্তানিতে যুক্ত হয়, তখন জাহাজ নির্মাণের বিশ্ববাজার ছিল চাঙা। রপ্তানির বাজার ধরতে তখন এগিয়ে আসে দেশীয় আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। শুধু ২০০৮ সালে ৫০টি জাহাজ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি পায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।
তবে পাঁচ বছরের মাথায় ইউরোপে আর্থিক সংকট শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশে উঠতি শিল্পটি বৈশ্বিক মন্দার কারণে আক্রান্ত হয়। কারণ, এই শিল্পে বড় রপ্তানি আদেশ আসত ইউরোপের দেশগুলো থেকে। আর্থিক সংকটের কারণে এ সময় ইউরোপের ব্যাংকগুলো জাহাজ নির্মাণ খাতে বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়। ফলে ইউরোপের আমদানিকারকেরা বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও তাদের অনেক রপ্তানি আদেশ বাতিল করতে বাধ্য হয়।
তবে রপ্তানি–বাণিজ্যের এ ধাক্কা সামাল দিতে রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বাজারের জন্য জাহাজ নির্মাণে ঝুঁকে পড়ে। কর্মী ছাঁটাই করে খরচ কমিয়ে আনে। পাশাপাশি ইউরোপের বাজারের বদলে আফ্রিকার বাজার ধরার চেষ্টা করে তারা। মধ্যপ্রাচ্যের জাহাজ রপ্তানির বাজারেও প্রবেশ করে। এ সময় চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে জাহাজ রপ্তানির বেশ কিছু কার্যাদেশ পায়। এরপরও ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি কেউ। তবে সরকারি নীতি সহায়তায় এই খাত এখন ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা।
জানতে চাইলে এইওএসআইবির সাধারণ সম্পাদক ও ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি উদ্যোগের কারণে এই শিল্পের সামনে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইউরোপ থেকেও এখন রপ্তানি আদেশ আসা শুরু হয়েছে। প্রায় ৮০০ কোটি টাকার চারটি বিশেষায়িত জাহাজের রপ্তানি আদেশ পাওয়ার কথা জানিয়ে এ উদ্যোক্তা বলেন, এখন রপ্তানি আদেশ পাওয়ার পর জাহাজ নির্মাণের জন্য ‘ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল’ দরকার। ব্যাংকগুলো এগিয়ে এলে নতুন নতুন রপ্তানি আদেশ পেতে সমস্যা হবে না।