>
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ এ (রুমী) আলী, ১৯৭৫ সালে তৎকালীন এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে চাকরিজীবন শুরু করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী, ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্র্যাক ব্যাংক ও বিকাশের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ব্যাংক খাতের নানা বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব।
প্রথম আলো: ৩০ বছরের বেশি ব্যাংক খাতের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এখন দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। কেমন চলছে দেশের ব্যাংক খাত?
মোহাম্মদ এ (রুমী) আলী: আর্থিক খাতের কার্যক্রমকে দুভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। প্রথমত, গত ১০ বছরে আর্থিক সেবা সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। বিকাশ, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অনেক মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে গেছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি অনেক হয়েছে। যারা ব্যাংকের সেবা নেওয়ার কথা চিন্তাও করত না, তারাও সেবা পাচ্ছে। এটা আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় অর্জন।
দ্বিতীয়ত, এ সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বড় একটা আলোচনার বিষয় হয়ে গেছে। সবার মধ্যেই ব্যাংক খাতের নানা আলোচনা জায়গা করে নিয়েছে। শেয়ারবাজারে ধস, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণেই ঋণখেলাপি হতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে তেমন কিছু ঘটেনি। এখানকার সমস্যা আর্থিক ব্যবস্থার দুর্বলতা। বলা যায়, খেলাপি ঋণ কোনো কারণ না, এটা হলো ফলাফল। এই ফলাফলের অন্যতম কারণ সারা বিশ্বে ব্যাংকিং পরিচালনায় যেসব ভালো চর্চা হয়, আমরা তা অনুসরণ করছি না, মানছি না। এর মধ্যে প্রধানতম হলো ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা। এটা শুধু মানা হচ্ছে না তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষাও করা হচ্ছে। তদারকির ব্যবস্থা জোরদার না হওয়ার কারণেও এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে। কেউ যদি জবাবদিহির মধ্যে না থাকে, তাহলে তো এভাবেই চলবে। ব্যাংকের কর্মকর্তা, পরিচালনা পর্ষদ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক—সবাইকে জবাবদিহির মধ্যে থাকতে হবে। সম্প্রতি যে তারল্যসংকট হলো, তার প্রধান কারণ ছিল যথাযথ তারল্য ব্যবস্থাপনা না করা।
সব মিলিয়ে আমাদের দেশে আর্থিক খাতে ভালো–খারাপ সব দিকই আছে। এখন প্রধান কাজ হলো ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার যে প্রধান দিকগুলো আছে, সেগুলোর নিয়মকানুন পরিপালনে চাপ বাড়াতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত থাকতে হবে।
প্রথম আলো: কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে? দেখা যাচ্ছে, বাইরের চাপে বড় বড় সিদ্ধান্ত হচ্ছে।
রুমী আলী: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা ও ব্যাংকগুলোকে তদারকির মধ্যে রাখা। বিশ্বের কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের বাইরে না। অর্থাৎ দেশের মধ্যেই কাজ করতে হয় সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো না, এটাও বুঝতে হবে। তবে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও সজাগ থাকতে হবে। বাইরে থেকে চাপ দিলেই সবকিছু মাথা পেতে নেওয়া যাবে না। কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে, দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। নতুন নতুন ঝুঁকির বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। সাইবার নিরাপত্তা তো এখন বড় একটা ঝুঁকি। আরও বড় ঝুঁকি হলো, এক ব্যাংকের কারণে অন্য ব্যাংকের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়া। এসব মোকাবিলায় কাজ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হলো, যেসব আইন আছে তা পালনে বাধ্য করা। যারা মানবে, তাদের পুরস্কৃত করতে হবে; যারা মানবে না, তাদের তিরস্কারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বাইরে থেকে চাপ দিয়ে ব্যাংকগুলো যেসব সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে, তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চাপ দিলেই যে সব মানতে হবে, এমন কথা নেই। বাইরে থেকে সবকিছু ঠিক করে দিলে মুদ্রানীতি ঠিক থাকবে না, এতে প্রবৃদ্ধিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
প্রথম আলো: ব্যাংকের পরিচালকেরা তো অন্য ব্যবসার মতো আর্থিক খাতকেও পরিচালনা করছেন। এমন কাঠামো নিয়ে কত দূর যাবে দেশের ব্যাংকগুলো?
রুমী আলী: ব্যাংক তো অন্য ব্যবসার মতো না। ব্যাংক চলে আমানতকারীদের টাকায়। তাঁরা বিশ্বাস করে ব্যাংকে টাকা রাখেন। উদ্যোক্তারা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ টাকা দেন। জনগণের টাকার সুরক্ষা দিতেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসেছে। পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের অবশ্যই নিয়মকানুন জানতে হবে। অনেক দেশে ঋণ অনুমোদনের সঙ্গে পর্ষদের কেউ জড়িত থাকেন না। ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে এসব সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশের পর্ষদেই বড় ঋণ অনুমোদন হয়। আবার এখানে পরস্পরবিরোধী আইনও আছে। বলা হচ্ছে, পর্ষদ ব্যাংকের নিয়মিত কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করবে না, আবার পর্ষদেই ঋণ অনুমোদন হচ্ছে। পর্ষদ ব্যাংকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করতে পারে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দিতে পারে এবং নীতিমালাও ঠিক করে দিতে পারে। এর বেশি না। কিন্তু ব্যাংকের বেশির ভাগ পরিচালকই প্রকৃত কাজ করছেন না। সুশাসন চাইলে, ব্যাংক খাতের উন্নয়ন চাইলে সবাইকে যাঁর যাঁর ভূমিকা রাখতে হবে। এর বেশি বা কম রাখা যাবে না।
প্রথম আলো: ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) যেভাবে বের করে দেওয়া হচ্ছে, তাতে পুরো খাতে আস্থার সংকট আরও বাড়ছে কি? গত ছয় মাসে পাঁচজন এমডি চাকরি হারিয়েছেন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
রুমী আলী: বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া তো কারও চাকরি চলে যেতে পারে না। কাউকে চাপ প্রয়োগ করে সরানোর খবর পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক না করতে পারে। তবে পাঁচজনকেই যে একই কারণে চলে যেতে হয়েছে, তা আমি বলব না। যদি কোনো ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে এমডিকে সরিয়ে দেওয়া হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে তখন পর্ষদকে যথাযথ শাস্তি দেওয়া। আবার যদি কোনো পর্ষদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে এমডিকে বের করে দেয়, তাহলে তো বাংলাদেশ ব্যাংকও এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে ছিল। এ জন্য সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
ব্যাংকের পর্ষদে তো বিভিন্ন পক্ষের পরিচালক থাকার পাশাপাশি স্বতন্ত্র পরিচালক থাকেন। এখন তারা যদি সব পক্ষই এক হয়ে যায়, তাহলে প্রশ্ন আসে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী দেখে তাঁদের পর্ষদে বসার অনুমোদন দিল? কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা দেওয়া হোক, এসব তদারকির জন্য। তবে তদারকি বিভাগগুলোর দায়িত্বে যাঁরা থাকবেন, তাঁদেরও কঠোর জবাবদিহির মধ্যে রাখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার এখনই শুরু করতে হবে।
প্রথম আলো: রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীনই আপনি ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন। কেমন চাপ ছিল?
রুমী আলী: আমার সময়ে ব্যক্তিগতভাবে কোনো চাপ পাইনি। না সরকারের পক্ষ থেকে, না অন্য কোনো মহল থেকে। তিন বছরে একবারের জন্যও আমাকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ফোন দেননি বা কোনো চিঠি পাঠাননি। ওই সময়ে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সৃষ্টিসহ বেশ কিছু সমস্যা হয়েছিল। এরপরও যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য নীতিমালার উদ্যোগ নিয়েও করতে পারিনি।
প্রথম আলো: বিয়াক কী নিয়ে কাজ করছে?
রুমী আলী: বাণিজ্যিক যে দ্বন্দ্ব আছে, তা নিরসন করাই বিয়াকের কাজ। মধ্যস্থতা ও সালিসির মাধ্যমে এটা করা হয়। আদালতে গেলে এসব মামলা বছরের পর বছর ঘুরে। কেউ হারে কেউ জেতে। তবে এ ব্যবস্থায় একটা সুরাহা হয়, কেউ বঞ্চিত হয় না। যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হয়। বিশ্বের অনেক দেশ আছে, যেখানে নিজেরা মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধান করে ফেলে। সমাধান না হলেই তারা মামলায় যায়। বাংলাদেশের আইনেও এ সুযোগ আছে, তবে চর্চা নেই।
আবার আর্থিক খাতে ঋণ নিয়েও আমরা কাজ করছি। অর্থঋণ আদালতে গেলে অনেক সময় লাগে। কেউ হারে, কেউ জেতে। আমরা চাই উভয় পক্ষের মধ্যে যৌক্তিক আলোচনা ও মধ্যস্থতা। কোনো ঋণ যখন সন্দেহজনক পর্যায়ে যায়, তখনই বিয়াকের তদারকিতে দিলে ভালো। এতে সহজেই সমাধান হয়। বিয়াক ভালোভাবে কাজ করতে পারলে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বা খেলাপি ঋণ নিয়ে বড় ধরনের সমালোচনা তৈরি হবে না।