জীবন যেখানে যেরকম

শিক্ষা জীবনের বহু বছর পেরিয়ে গেলেও ছাত্র তকমা ছাড়তে কেন যেন মন সায় দেয় না। তাই মাস্টার্স শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পিএইচডি ডিগ্রির জন্য আবেদন শুরু করে দিলাম। অগণিত আবেদন। ছয়টি দেশে অনলাইনে ইন্টারভিউ দেওয়ার পর তিনটি ভিন্ন দেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলাম। বহু চিন্তা ভাবনার পর অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্বান বিশ্ববিদ্যালয়ের (Auburn University) আহ্বানে সাড়া দিলাম।

দক্ষিণ কোরিয়ায় মাস্টার্স করার সুবাদে প্রবাস জীবন আমার কাছে নতুন নয়। অনেকটাই শান্ত ছিলাম। যদিও অজানা আশঙ্কা মনে ভালোভাবেই ছিল। দেশ ছাড়ার আগে অর্বান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র একজন বাংলাদেশি ভাইয়ের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ করি। যা আমার জীবন অনেক সহজ করে দেয়।
সদ্য পরিচয় হওয়া একজনের জন্য বাড়ি ভাড়া করে দেওয়া, এমনকি প্রথম কয়েক দিন নিজ বাড়িতে রাখা, সম্ভবত বাংলাদেশি মানুষের পক্ষেই সম্ভব। আমেরিকাতে জনপরিবহন যোগাযোগ বেশ অপ্রতুল। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রায় নেই বললেই চলে। যা হোক, বাংলাদেশি ছাত্রদের সর্বাত্মক সাহায্যের কথা এ ক্ষেত্রে না বললেই নয়। বিছানাপত্র কেনা থেকে শুরু করে জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সকল কিছুই তাদের সহযোগিতায় বাজার থেকে নিজ বাসা অবধি নিয়ে আসতে সক্ষম হই।

নিয়মমাফিক ক্লাস শুরু হওয়ার পাঁচ দিন আগেই আমি আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই। সময়টা আগস্ট ২০১৮। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের গরমের আবহাওয়ার সঙ্গে পরিচিতি না থাকার কারণে প্রথম দিনেই ক্লান্তি জেঁকে ধরেছিল। এরপর পিএইচডি সুপারভাইজারের সঙ্গে দেখা করার পালা। সুপারভাইজার মধ্যবয়স্ক ও হাসিখুশি স্বভাবের মানুষ। তাঁর আদিনিবাস বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ নেপালে। তিনি আমার আগেও বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি ছাত্রের সুপারভাইজার হিসেবে গবেষণার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।

প্রথম দেখাতেই আমাকে বললেন, তিনি আশা করেন বাংলাদেশি সংস্কৃতি থেকে আসা আমি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দেব না এবং যেকোনো বিপদের পূর্বাভাস পাওয়া মাত্রই নিজেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতি যে বিদেশিদের অনুকূলে না, সেটা আমি আরেকবার উপলব্ধি করলাম। কিন্তু আমার সহকর্মীদের কেউই ঠিক অচিন দেশের লোক নয়। সবাই আমাদের সুপরিচিত ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ। ঘনিষ্ঠতা হতে মোটেও সময় লাগল না এবং এই ঘনিষ্ঠতাই সুকঠিন পাঠ্যক্রম অনেকটাই সহজ করে দিল।

মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচুর সময় ব্যয় হয় শুধুমাত্র বিষয়ভিত্তিক শ্রেণিকক্ষ পড়াশোনায়। মাস্টার্স ও পিএইচডির ক্ষেত্রে সেটার সঙ্গে যুক্ত হয় গবেষণা। সুতরাং সেমিস্টার চলাকালে অনেকেরই নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেতে হয়। এরপরও জীবনে আনন্দ-উল্লাস থেমে থাকে না। আর সেটা যদি হয় ত্রিশ হাজার ছাত্রছাত্রী অধ্যুষিত বিশ্ববিদ্যালয় শহর (College Town), তা বলাই বাহুল্য। অর্বান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আকর্ষণ আমেরিকান ফুটবল দল যারা Tigers নামেই সুপরিচিত। অর্বান শহরে হাই-হ্যালোর কাজও চালানো হয় ফুটবল দলের রণসংগীত ‘WarEagle’–এর মাধ্যমে।

শুধু তাই না, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই ৮৭ হাজার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন নিজস্ব স্টেডিয়াম আছে। যা অর্বান বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্মারক। খেলার নির্ধারিত দিনে ছোট অর্বান শহরের চেহারাই পালটে যায়। দূরদূরান্ত থেকে লোক আসে নিজেদের বিচিত্র বাহন করে। পুরা ক্যাম্পাস ছেয়ে যায় Tail Gate নামে টানানো তাঁবুতে। যেখানে দর্শনার্থীদের জন্য থাকে খাবার ও টেলিভিশনে খেলা দেখার ব্যবস্থা। অর্বান ফুটবল দলের বিজয় উদ্যাপন আরও বিচিত্র। সারা শহরের মানুষ জড় হন ক্যাম্পাসের স্যামফোর্ড হলের (Samford Hall) প্রাঙ্গণে। যেখানে তারা ছুড়ে মারেন টয়লেট টিস্যু গাছের সারিতে। না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। দূর থেকে দেখলে হঠাৎ তুষারপাত বলে ভুল হতে পারে। ফুটবল ছাড়াও আছে হ্যালোউন উৎসব। যেখানে শহরতলির রাস্তা ঘণ্টাখানেকের জন্য বন্ধ রাখা হয় শুধু আনন্দের জন্য।

দেখতে দেখতেই সেমিস্টারের অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসে। শুরু হয় শিক্ষার্থীদের হাড়ভাঙা খাটুনি। পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রোজেক্ট—দম ফেলার ফুরসত থাকে না। ক্রিসমাসের আগে আগে সব পাঠ্যক্রম শেষ হয়। এবার শিক্ষার্থীদের বাড়ি ফেলার পালা। হঠাৎ করেই যেন অর্বান নামের ছোট্ট শহরটা ভূতের শহর হয়ে যায়। শহরে থাকেন কেবল আমাদের মতো কিছু পরবাসী মানুষ। অপেক্ষায় থাকেন কবে আবার বসবে মানুষের হাট, এই ছবির মতো সুন্দর ক্যাম্পাসে।
তাওসীফ রহমান: অর্বান বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র।