কিশোরদের খোলা জানালা
ঝলমলে ওয়েব ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে শোভা পাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের শৈশব নিয়ে লেখা ফিচার ‘রাখাল বালকের বিশ্ব জয়’, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর তথ্য নিয়ে আয়োজন ‘এক ডজন ফ্যাক্টস’ কিংবা ‘কার্বন ডাই–অক্সাইড থেকে জ্বালানি’ শিরোনামের লেখা। এখানেই শেষ নয় স্মৃতিকথা, ভ্রমণ, চলচ্চিত্র, কার্টুনসহ বাদ পড়েনি প্রায় কোনো বিষয়।
আকর্ষণীয় ছবি ও অলংকরণে সমৃদ্ধ এই ওয়েব ম্যাগাজিনের নাম ‘রিফ্লেকটিভ টিনজ’। কিশোর পাঠকদের জন্য তৈরি এই ম্যাগাজিনের সব লেখা লিখেছে কিশোরেরাই। ওয়েবসাইট তৈরি ও পরিচালনা যারা করছে তারও কিশোর। কিশোর-তরুণ পাঠকেরা যেন সাইটটিতে নিবন্ধিত হয়ে লিখতে পারে সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে সৃজনশীল কর্মযজ্ঞের একটা খোলা জানালা যেন সাইটটি।
ওয়েবসাইটের হোমপেজে অ্যাপলের তৈরি ‘দ্য স্টার্ট অব সামথিং ডিফারেন্ট’ শিরোনামের দুই মিনিট চুয়ান্ন সেকেন্ডের একটি ভিডিও পাওয়া গেল। ভিডিওটি দেখলেই যেন নতুন কিছু করার উদ্দীপনা পাওয়া যায়। আর রিফ্লেকটিভ টিনজের উদ্দেশ্যও যেন সেটাই। কিশোর-তরুণদের নিয়ে সৃজনযজ্ঞে মাততেই এর পথ চলা শুরু।
শুরুটা করেছিল চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ইউসুফ মুন্না। বর্তমানে এই ওয়েবসাইটের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে সে। এ যাত্রায় মুন্নার সঙ্গে আছে তাহমিদ বাশার, শাহরিয়ার তামিম ও ইসতিয়াক আহমেদ। তাদের সবার বয়স ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। ৬ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো চট্টগ্রাম কার্যালয়ে কথা হয় তাদের সঙ্গে।
ইউসুফ মুন্না জানায়, ১১ বছর বয়স থেকেই ইন্টারনেটে তার লেখালেখি শুরু। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সাহিত্য–বিষয়ক লেখা পড়ে সময় কাটত। এতসব ওয়েবসাইটের ভিড়ে এ দেশের কিশোরদের জন্য তেমন কোনো আয়োজন নেই দেখে হতাশই হয় সে। এরপর মাথায় আসে একটি ওয়েব ম্যাগাজিন তৈরির। বাকিটা মুন্নার মুখ থেকেই শোনা যাক। ‘আমি এমন কিছু করতে চাইছিলাম, যেখানে সবকিছুই হবে আমাদের মতো এবং আমাদের জন্য। লেখালেখির প্রতি আমার ঝোঁক ছিল। আবার নতুন কিছু করতেও ভালো লাগত। সেখান থেকেই অনলাইন ম্যাগাজিনের বিষয়টা মাথায় আসে।’
শুরুর দিকে অবশ্য অনেক বাধা পার করতে হয়েছে। তখন ওয়েব ডিজাইন সম্পর্কে ধারণা ছিল না। তাই ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে ওয়েব সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান উইবলির ওয়েবসাইটে গিয়ে বিনা মূল্যে ডোমেইন নিয়ে ওয়েবসাইট তৈরি করে মুন্না। যার নাম রাখা হয় ‘রিফ্লেকটিভ টিনজ’। তখন মুন্না চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। ওয়েবসাইট তৈরির পর ফেসবুকের মাধ্যমে লেখা আহ্বান ও প্রচার–প্রচারণা চলতে থাকে। এ সময় মুন্নার সঙ্গে যুক্ত হয় আরও তিন বন্ধু। তবে বর্তমানে ‘রিফ্লেকটিভ টিনজ’ পরিবারের সদস্য ২৪ জন।
২৪ জন কীভাবে যুক্ত হলো? মুন্নার উত্তর, ‘চট্টগ্রামের সাতটি স্কুল, তিনটি কলেজ ও একটি মাদ্রাসায় আমাদের একজন করে ক্যাম্পাস প্রতিনিধি রয়েছে। যাদের নেতৃত্বে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে রয়েছে একটি করে সৃজনশীল দল। এ ছাড়া আমাদের তিনজন উপদেষ্টা রয়েছেন, যাদের প্রেরণা ও অর্থায়নে আমরা এত বড় কাজ করতে পারছি।’ বর্তমানে এই সাইটের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ইসতিয়াক আহমেদ। এ ছাড়া জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছে বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদ্রাসার আলীম প্রথম বর্ষের ছাত্র শাহরিয়ার তামিম এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছে কলেজিয়েট স্কুলের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে পড়ছে তাহমিদ বাশার।
ওয়েবসাইটের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কিশোরেরা জানায়, গল্প, কবিতাসহ বিজ্ঞান ও সাহিত্যের কিশোর উপযোগী লেখা এই ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। রয়েছে কিশোরদের নানা ধরনের আঁকা-আঁকি প্রকাশের ব্যবস্থাও। যেসব কিশোর গান, আলোকচিত্র, অভিনয় কিংবা আবৃত্তি করে তাদের জন্যও এই ওয়েবসাইটে রয়েছে নানা আয়োজন। এর পাশাপাশি প্রতি মাসে ওয়েব ম্যাগাজিনের নির্বাচিত লেখকদের পুরস্কৃতও করা হয়। এ ছাড়া ২০১৪ সালে এই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখা নিয়ে একটি সংকলন চলতি সেপ্টেম্বর মাসেই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে বলে জানাল তরুণেরা।
এসবের বাইরে মানবতার সেবায়ও হাত বাড়িয়েছে এই তরুণেরা। ইউসুফ মুন্না বলে, ‘আমরা রিফ্লেকটিভ টিনজ ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠনও পরিচালনা করি। এর মাধ্যমে আমরা মহেশখালীর বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে ইন্টারনেট ও বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মশালা পরিচালনা করেছি। সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় একটি অনলাইন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কাজ করছি।’
স্বপ্ন বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? তরুণেরা জানায়, আগামী ২০২২ সালের মধ্যে দেশের গণ্ডি পার হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোতেও নিজেদের এই অনলাইন ম্যাগাজিনকে জনপ্রিয় করে তুলতে চায় এই তরুণেরা। তরুণদের কথা ঠিক হলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে www.reflectiveteens.com এই ঠিকানায় গিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েক কোটি পাঠক প্রতিদিন পড়বে রিফ্লেকটিভ টিনজ।