কাজী নজরুল ইসলামের কোলে বসে হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর। রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য সরাসরি পাননি। পেয়েছেন কবির রচনায়। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শুধু ঘনিষ্ঠ সাহচর্যই পাননি, কলকাতায় ছাত্রজীবনে একসঙ্গে হোস্টেলে থেকেছেন, অংশ নিয়েছেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। ‘এই তিনজন হলেন আমার আদর্শ। প্রেরণার উৎস। আমার নায়ক। তাঁদের ছবি আমার ঘরে টাঙানো রয়েছে। আমার বাংলা, আমার বাঙালিত্ব আবিষ্কারের যে চেষ্টা সারা জীবন করেছি, সেখানে তাঁদের অবদান অপরিসীম।’ নব্বইয়ে পৌঁছানো উপলক্ষে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনায় এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম।
গতকাল শনিবার বিকেলে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ৯০ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। যৌথভাবে বাংলা একাডেমি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ এর আয়োজন করে।
বগুড়ার মহাস্থানগড়ের পাশে চিঙ্গাশপুর গ্রামে ১৯২৭ সালের ১ মে মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জন্ম। মা রাবেয়া খাতুন, বাবা সা’দত আলি আখন্দ ছিলেন স্বনামখ্যাত লেখক। মা-বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান নূরউল ইসলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় থেকে স্নাতকোত্তর ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। শৈশব থেকেই সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ, ছাত্রজীবনে বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ ও ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ তাঁর চিন্তা ও কর্মে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে।
অধ্যাপক মুস্তাফা নূরুউল ইসলামের কর্মজীবন বিচিত্র, বর্ণাঢ্য। সাংবাদিকতা করেছেন। দৈনিক সংবাদ-এর প্রথম সংখ্যা থেকে যুক্ত ছিলেন সহকারী সম্পাদক হিসেবে। কাজ করেছেন মিল্লাত-এ। শিক্ষকতা করেছেন সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজ, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে (খণ্ডকালীন)। দায়িত্ব পালন করেছেন শিল্পকলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, জাতীয় জাদুঘরের সভাপতি হিসেবে।
প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, অনুবাদ, সম্পাদনা মিলিয়ে মুস্তাফা নূরুউল ইসলামের প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় অর্ধশত। সম্পাদনায় যুক্ত থেকেছেন পূর্বমেঘ, অগত্যা, সুন্দরম নামের তিনটি বিখ্যাত পত্রিকার। ১৯৫০-এর দশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় আলাউদ্দিন আল আজাদের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদিত দাঙ্গার পাঁচটি গল্প তাঁর একটি সাড়া জাগানো প্রকাশনা। অধ্যাপনা ও গবেষণার পাশাপাশি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান উপস্থাপনাতেও বিশেষ মাত্রা যোগ করেছেন তিনি। দেশ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সাহিত্য নিয়ে বিচিত্র বিষয়ে তিনি দীর্ঘকাল ধরে মুক্তধারা, কথামালা, বাঙালির বাংলা নামে অনুষ্ঠান করে আসছেন। একটি নিজস্ব বাকভঙ্গির জন্যও তিনি বিদগ্ধ মহলে প্রশংসিত হয়েছেন।
স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তবে গতকাল নাগরিক সংবর্ধনার প্রতিক্রিয়ায় বললেন, ‘আমার সমসাময়িক এখন আর কেউ নেই। পেছনে তাকালে নিজেকেই সময়ের মুখ বলে মনে হয়। জীবনে অতৃপ্তি কিছু নেই। যা চেয়েছি তা পেয়েছি। এই বৃদ্ধ বয়সে যে সংবর্ধনা পেলাম, তা কখনো ভুলব না।’
অনুষ্ঠানের সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ৯০ বছরের দীর্ঘ জীবন বলেই আলাদা করে তা মূল্যবান নয়, যদি না সে জীবনে উল্লেখযোগ্য কর্ম ও কৃতিতে ভাস্বর হয়ে ওঠে। তাঁর দীর্ঘ জীবন নানা উল্লেখযোগ্য কর্ম ও সৃজনশীলতায় বিশিষ্টতা অর্জন করেছে।
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গাওয়া ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গানটি দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এরপর অধ্যাপক ইসলামের সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়ে শোনান সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। সম্মাননাপত্র পাঠ করেন মফিদুল হক। এরপর ছিল আলোচনা, আবৃত্তি, নিবেদিত কবিতা পাঠ, ফল ও উত্তরীয় দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো।
মুস্তাফা নূরুউল ইসলামের ওপর আলোচনা করেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বিশ্বজিৎ ঘোষ, নূহ-উল-আলম লেনিন, রামেন্দু মজুমদার ও কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ। আবৃত্তি করেন হাসান আরিফ, নিবেদিত কবিতা পড়েন তারিক সুজাত। পরে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিগতভাবে অনেকে তাঁকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান এবং তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করেন।