শরীর ৭ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে তারা মিয়ার (৪০)। মেয়ে তানজিনার (৮) ৮ শতাংশ। বাবা-মেয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে একই বিছানায় শুয়ে। নিজের কষ্ট ভুলে নির্বাক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন তারা মিয়া। তখনো তিনি জানেন না, স্ত্রী সোনাভানু (৩৩) ও ছেলে সুজন (১৩) এই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। ছেলে গতকাল শনিবার সকাল সাতটায়, আর স্ত্রী ভোররাত সোয়া তিনটায় মারা যান।
একই পরিবারের এই চার সদস্য গত শুক্রবার দিবাগত রাতে বাসে করে ঢাকায় যাওয়ার পথে গাইবান্ধার তুলসীঘাট এলাকায় পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হন।
তারা মিয়ার বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চণ্ডীপুরের পাইকপাড়া গ্রামে। তিনি দিনমজুর। স্ত্রী ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন। তারা মিয়া স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। তাঁদের আরও দুই সন্তান ঢাকায় তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকায় বিমানবন্দরের পাশে একটি এলাকায় থাকেন তারা মিয়া।
বার্ন ইউনিটের শয্যায় কাতরাতে কাতরাতে তারা মিয়া বললেন, ‘কিছু বুঝি উঠবার আগোত বাসোত দেখি দাউ দাউ করিয়া আগুন জ্বলতোছে। দিগ্বিদিক না পায়া মোর সিটের সাথোত থাকা একটা ছাওয়াক নিয়া জানালা দিয়া বের হবার পারছি। কিন্তু বউ আর একটা ছাওয়ার খবর জানোও না। তবে শুনছোও এই হাসপাতালোত আছে।’
ভারী হয়ে উঠেছে বার্ন ইউনিটের বাতাস: এদিকে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আহত দগ্ধদের আহাজারিতে সেখানকার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কিছু একটা জানতে চাইলে বোমা হামলায় দগ্ধ পোশাককর্মী সুজান মিয়া (৩০) চিৎকার করে বলেন, ‘হামার কাছোত কেনে জাইনবার চান? যারা রাজনীতি করে ওমারগুলার কাছোত জাইনবার চান। হামরা সবায় গরিব মানুষ। হামাক কেনে মারে?’
গাইবান্ধার তুলসীঘাটে চলন্ত বাসে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ১৮ জনের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। এই পাঁচজন হলেন সুন্দরগঞ্জের চণ্ডীপুর এলাকার রিকশাচালক সাজু মিয়া (২৮), তাঁর ৯০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তিনি ঢাকায় রিকশা চালান। একই এলাকার দিনমজুর আবুল কালামের (৪০) ৫৫ শতাংশ, কামারের ভিটা এলাকার রিকশাচালক মোতালেবের (৫০) ৩০ শতাংশ ও শান্তিধাম এলাকার রিকশাচালক জাহাঙ্গীরের (৩৪) ২৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।
বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন সাইদুল ইসলাম (৩৫) ঢাকায় রিকশার গ্যারেজে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার সাথে সাথে আমি জানালা দিয়া বের হতে পারছি বলে কম পুড়ছি। যারা দরজা দিয়া বের হওয়ার চেষ্টা করছিল, তাদের বেশি ক্ষতি হইছে।’
বিজিবির সিপাহি বদিউজ্জামান (২৪) বলেন, ‘বাড়ি আসছিলাম, ছুটি শেষ, চাকরিতে জয়েন (যোগদান) করতে হবে। তাই এই বাসে চড়ে ঢাকা যাচ্ছিলাম। কে জানে যে এত বড় ঘটনা ঘটবে।’
এদিকে চিকিৎসাধীন দগ্ধ ১৮ জনের মধ্যে অধিকাংশই রিকশাচালক, দিনমজুর, তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী। এদের অধিকাংশের বাড়িও সুন্দরগঞ্জ উপজেলায়। তারা সবাই একসঙ্গে একই বাসে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। অন্য আহত ব্যক্তি হলেন রফিকুল ইসলাম (২৫), নজরুল ইসলাম (৩০), কায়সার আলী (৪০), বিজয় (১০), তানজিনা (৮), মঞ্জুরুল ইসলাম (৩০), জ্যোৎস্না (২২), সাইফুল (২৫), গাইবান্ধার পলাশবাড়ী এলাকার আমিনুর (২৪), কুড়িগ্রামের চিলমারীর বুলবুলি (২৩)।
হাসপাতালের পরিচালক আবদুল কাদের খান বলেন, সারা রাত ধরে চিকিৎসক ও সেবিকারা দগ্ধদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হচ্ছে না এখানে। দগ্ধদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।