শিক্ষিত মানুষের গ্রাম
গ্রামটি দুর্গম, কিন্তু সব মানুষ অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। বিবাদ-বিসংবাদ না থাকায় গ্রামটি অপরাধমুক্ত। সে কারণে নেই মামলা-মোকদ্দমার ঝামেলাও।
যমুনা আর হুরাসাগর নদীর সঙ্গমস্থলে বিচ্ছিন্ন জনপদ সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার গালা ইউনিয়নের দেওয়ান তারটিয়া গ্রাম। উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামটিতে সরাসরি যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। শুষ্ক মৌসুমে হেঁটে এবং বর্ষায় নৌকায় হুরাসাগর পাড়ি দিয়ে গ্রামটির বাসিন্দাদের উপজেলা সদরে যাতায়াত করতে হয়।
দুর্গম হওয়া সত্ত্বেও গ্রামটির বেশির ভাগ বাসিন্দা উচ্চশিক্ষিত। দীর্ঘদিন থেকে গ্রামের অনেক লোক সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ পদে চাকরি করে আসছেন। চাকরিই এই গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা। এই গ্রামে স্বাধীনতার পর কখনো পুলিশ এসেছে কি না, তা মনে করতে পারেননি সেখানকার প্রবীণ বাসিন্দারাও। গ্রামবাসী দাবি করেন, তাঁদের গ্রামটি শতভাগ নিরক্ষরমুক্ত।
সম্প্রতি সরেজমিনে গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রামটিতে ১৯১১ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। এর পর থেকেই সেখানে শিক্ষার হার বাড়তে থাকে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে ওই গ্রামে শিক্ষার হার শতভাগে উন্নীত হয়। এর পর থেকে উচ্চশিক্ষার হারও প্রতিবছর বাড়ছে। গ্রামের সবচেয়ে কাছের উচ্চবিদ্যালয়টি এক কিলোমিটার দূরে, ভেড়াকোলা উচ্চবিদ্যালয়। রাস্তা ভালো না হওয়ায় হেঁটেই বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতে হয় শিক্ষার্থীদের।
গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, ইংরেজ আমলে প্রত্যন্ত এলাকার কেউ ম্যাট্রিক (এসএসসি) পাস করলে লোকজন ভিড় করে তাঁকে দেখতে আসতেন। অথচ সেই আমলেই এই গ্রামের ৩০ থেকে ৩৫ জন ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের একজন খাজা আবদুল জলিল কলকাতায় গিয়ে স্নাতকোত্তর ও চারজন স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী ব্যক্তিরা হলেন সৈয়দ কোবাদ আলী, আবুল মোহছেন খান, সৈয়দ আবদুর রহিম ও আবদুল খালেক খান। তাঁরা সেই সময়ে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন। ওই পাঁচ কৃতীই পরবর্তী সময়ে গ্রামে শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখেন।
গ্রামের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ আবদুল হালিম (৭৫) বলেন, ‘সেই পঞ্চাশের দশকেই আমরা দেখেছি গ্রামে লেখাপড়া ছিল অনেকটা বাধ্যতামূলক। মুরব্বিরা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে অভিভাবকদের চাপ দিতেন। যেসব অভিভাবক সন্তানদের স্কুলে পাঠাতেন না, তাঁরা উপহাসের পাত্র হতেন। এ কারণে অভাব-অনটন বা নানা সমস্যার মধ্যেও গ্রামের সবাই সন্তানদের স্কুলে পাঠাতেন। এভাবে লেখাপড়ার প্রতি গ্রামের মানুষের আগ্রহ উত্তরোত্তর বেড়েছে। এখন কোনো শিশুর অশিক্ষিত হয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ নেই এখানে।’
শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই গ্রামটি এগিয়ে, তা নয়। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রেও এই গ্রামটি আদর্শ। তাই গ্রামটি বিবাদ, হানাহানি এবং মামলা-মোকদ্দমা থেকে মুক্ত। মাঝেমধ্যে পারিবারিক কিছু বিচ্ছিন্ন সমস্যা তৈরি হলেও গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিরা বৈঠক করে তা মীমাংসা করে দেন। গ্রামের বাসিন্দা দেওয়ান তারটিয়া শাখা ডাকঘরের পোস্টমাস্টার সৈয়দ আজিজুর রহমান (৫৭) বলেন, ‘গ্রামের ওপর দিয়ে অন্য এলাকায় যাওয়ার জন্য পুলিশ এসেছে। কিন্তু কেবল আমাদের গ্রামের উদ্দেশে কোনো দিন পুলিশ এসেছে বলে মনে পড়ে না। আসলে এখানে কোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে না। গ্রামের সবাই শিক্ষিত ও সচেতন। তাই আমাদের গ্রামটি অপরাধমুক্ত।’
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও দেওয়ান তারটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি সৈয়দ আবদুর রশীদ (৭০) বলেন, তাঁরা একসঙ্গে বসে অভিভাবকদের কাছে তাঁদের সন্তানদের পড়ালেখার বিষয়ে খোঁজ নেন। টাকাপয়সার সমস্যার কারণে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কারও যাতে পড়াশোনার বিঘ্ন না ঘটে, সে জন্য তাঁরা চাঁদা তুলে সহায়তা করেন। অসচ্ছল কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তাঁর চিকিৎসার খরচও গ্রামের সামর্থ্যবানেরা চাঁদা তুলে জোগান দেন বলে জানান তিনি।
গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য আকমল হোসেন বলেন, ‘বাইরের এলাকায় যাতায়াতে আমাদের কষ্ট হয়। এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় সেই কষ্ট আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু স্থানীয় বাজারসহ পাশের গ্রামগুলোতে যাতায়াতের উপযুক্ত রাস্তা না থাকার বিষয়টি আমরা মানতে পারি না।’
গালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, ‘দুর্গম ও প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও দেওয়ান তারটিয়া শিক্ষিত ও ভদ্রলোকের গ্রাম। আমার ইউনিয়নে এমন একটি গ্রাম থাকায় বেশ গর্ব হয়। গ্রামটির রাস্তাঘাট উন্নয়নে কয়েক বছরে অনেক কাজ করেছি। কিন্তু বর্ষায় তা টেকেনি।’
দেওয়ান তারটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘আমরা জরিপ করে দেখেছি, গ্রামের শতভাগ শিশুই বিদ্যালয়ে পড়ছে।’
গ্রামটিতে একসময় দেড় হাজারের বেশি লোক বাস করতেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে নদীভাঙনে গ্রামের একটি বড় অংশ বিলীন হওয়ায় এবং চাকরির সূত্রে অনেক পরিবার গ্রাম ছেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা ৬০০ থেকে ৭০০।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামিম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত দূর জানি, দেওয়ান তারটিয়ায় গ্রামবাসীর উদ্যোগেই শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত হয়েছে। দুর্গম এই গ্রামে এলাকার বিদ্যানুরাগীরা যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা অনুকরণীয় এবং অন্য গ্রামের জন্য অনুপ্রেরণার।’