কবিহীন কবির ঘর

রাজধানীর শ্যামলীতে নিজ বাসভবনে কবি শামসুর রাহমান। জন্ম ২৩ অক্টোবর ১৯২৯। মৃত্যু ১৭ আগস্ট ২০০৬।

‘আমার উঠোন’ নামে এক গদ্যে শামসুর রাহমান নিজ ঘরের প্রতি প্রিয়তা প্রকাশ করতে স্প্যানিশ কবি মিগুয়েল হার্নান্দেজকে উদ্ধৃত করেছেন, ‘আমার বাগানের লেবুগাছ আমার কাব্যে যে প্রভাব বিস্তার করেছে, তা সকল কবির মিলিত প্রভাবের চেয়েও বেশি।’ তাঁর নিজের অন্তত তিনটি বইয়ের নামের দিকে তাকালেই (নিজ বাসভূমে, প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে, সৌন্দর্য আমার ঘরে) বুঝতে পারি জনতার কণ্ঠ যাঁর কবিতায় পেয়েছে স্বচ্ছন্দ অভিষেক, তিনিও নিজস্ব ঘর আর বসতির প্রেমী; তা সে ব্যক্তির জন্য হোক আর সমষ্টির তরেই হোক। তাঁর কবিতা ও স্মৃতিশব্দে ফিরে ফিরে এসেছে আপন আলয় নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামের বাড়ি, জন্মস্থল ঢাকার ৪৬ নম্বর মাহুতটুলী, সুদীর্ঘ বাসভূমি ৩০ নম্বর সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেন বা আশেক লেন আর জীবনের সর্বশেষ ঠাঁই শ্যামলীর ১ নম্বর সড়কের বাড়ি নম্বর ৩/১।

আত্মকথা কালের ধুলোয় লেখায় কবির বয়ানেই খুঁজে পাওয়া যায় নগর ঢাকাতে তাঁর বাস-পরিক্রমা:

‘প্রথম মহাযুদ্ধের বারুদের গন্ধ হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার এগারো বছর পর ১৯২৯ সালে আমি সর্বপ্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম পুরনো ঢাকার মাহুতটুলীর এক সরু গলির ভিতর’।

জন্মের বছর এগারো পর ১৯৪০ সালে ‘আমরা মাহুতটুলী ছেড়ে শহর থেকে দূরে পল্লীপ্রতিম ইস্কাটনে চলে গেলাম।’

আশি বছর আগে পুরান ঢাকার সাপেক্ষে আজকের ইস্কাটন ‘পল্লিপ্রতিম’ই ছিল বলা চলে।

এর দেড় বছর পর ‘দুর্ভিক্ষের হাভাতে ছায়ায় আমরা ইস্কাটন ছেড়ে মাহুতটুলীতে ফিরে এলাম।’

মাধ্যমিক পাসের পর ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে কবি আবিষ্কার করলেন মূল কলেজ ক্যাম্পাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক-আস্তানায় পরিণত। অপরিসর সিদ্দিক বাজারের স্থানান্তরিত কলেজে পড়ার কালেই তাঁর পিতা যেনবা মনের প্রসারতা বাড়াতে ছেলেকে ঢাকা কলেজের হোস্টেল অর্থাৎ বেগমবাজারের ‘নূরপুর ভিলা’য় থাকার ব্যবস্থা করেন৷

দুই মাসের অসহ্য হোস্টেল-বাসের পর আবার মাহুতটুলী আর ‘কলেজের বেড়া ডিঙ্গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে আমি সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেনের এক পুরনো বাড়িতে চলে এলাম।’

বলা চলে, মাহুতটুলীর বাড়িতে যে কবিসত্তার অন্তর্গত নির্জন মুঞ্জরণ শুরু, তা-ই পুষ্পপল্লবিত হয়েছে আশেক লেনের বাড়িতে। কবিতায়ও উঠে এসেছে কবির পুরোনো পাড়া:

‘বাচ্চু, তুমি, বাচ্চু তুই, চলে যাও, চলে যা সেখানে/ ছেচল্লিশ মাহুতটুলীর খোলা ছাদে।’ (দুঃসময়ে মুখোমুখি)

কিংবা—

‘ডায়েরি খুলে নিশুতি রাতে কবিতা লিখতে শুরু করি/ আমার যৌবনের প্রত্যুষ থেকে প্রৌঢ়ত্বের ঊষাকালে/ সাক্ষী, আশ্রয়দাতা এবং সখা/ আশেক লেনের সেই ক্ষয়াটে, থুত্থুড়ে বাড়ির উদ্দেশে।’ (আশেক লেনের বাড়ি)

প্রিয় আশেক লেন ছেড়ে কবি-পরিবারকে একসময় চলে আসতে হয় তল্লাবাগ এলাকায়। কিন্তু পুরান ঢাকার ঘ্রাণমুগ্ধ কবির নতুন নস্টালজিয়া তৈরির অপেক্ষায় ছিল যেন ‘শ্যামলী’; যেখানে জীবনের শেষ পনেরো বছরের বসবাসে নানা জরা ও দুর্ঘটনা পেরিয়েও তিনি থেকেছেন সৃষ্টিমুখর। কবির প্রিয় পুত্রবধূ টিয়া রাহমান জানান, ১৯৯০–এর ডিসেম্বরে শ্যামলীতে বসবাস শুরু শামসুর রাহমানের। কবির ভাষ্যে বাড়িটি উঠে এসেছে এভাবে:

‘শ্যামলীর একটি গলির শেষ প্রান্তে আমার বিনীত নিবাস দাঁড়িয়ে আছে কোনও সাধকের মতো, যে অনেকের মধ্যে থেকেও যেন কেমন নিঃসঙ্গ, আলাদা। একজন বাউলের মতোই সাদাসিধে লেবাসে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক কোণে একতারা হাতে। সেই একতারার সুর সবাই শুনতে পায় না, কেউ কেউ শোনে খাঁ খাঁ দুপুরে কিংবা গহীন রাতে। কেউ যদি শুনতে না পায় তাহলে আমার কোনও খেদ নেই। অন্তত আমি তো শুনতে পাই খোলা মাঠের হৃদয় থেকে উঠে-আসা মন-কেমন করা এক গহীন সুর।’

মন-কেমন করা বাড়িটি ছেড়ে কবি চলে গেছেন ২০০৬ সালের আজকের দিনে; তাই বুঝি বাড়িটিরও মন ভালো নেই মোটেও। এই বাড়িতে বসেই তো কবি লিখেছেন ধ্বংসের কিনারে বসে হতে অন্ধকার থেকে আলোয় পর্যন্ত ২৪টি কবিতার বই, রংধনুর সাঁকো থেকে চাঁদ জেগেছে নদীর বুকে-এর মতো ছয়টি ছড়ার বই। গদ্যগ্রন্থ শামসুর রাহমানের প্রবন্ধ, কবিতা এক ধরনের আশ্রয়, শামসুর রাহমানের গল্প, উপন্যাস এলো সে অবেলায় আর আত্মজীবনী কালের ধুলোয় লেখাও রচিত হয়েছে শ্যামলীর ছোট্ট-ছিমছাম বাড়ির প্রাণ-পরিসরে। আবার এই বাড়িতেই তো দুঃখ বারংবার লিখেছে তার নাম। এখানে থাকতেই ১৯৯৭ সালে হারিয়েছেন প্রিয় মা আমেনা খাতুনকে, এই বাড়িতেই কবির ওপর হামলে পড়েছে মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা।

কবি মির্জা গালিবের সৃষ্টিসূত্রে যেমন দিল্লির বিল্লিমারান মহল্লার ঘর আজ এক প্রশস্ত প্রেমপ্রান্তরের নাম, তেমনি শামসুর রাহমানের স্মৃতি ও সৃজন-সমুজ্জ্বল শ্যামলীর কবিঘর যেন তাঁর বইয়ের শিরোনামের মতোই যথার্থ এক ‘মেঘলোকে মনোজ নিবাস’।

কবি মির্জা গালিবের সৃষ্টিসূত্রে যেমন দিল্লির বিল্লিমারান মহল্লার ঘর আজ এক প্রশস্ত প্রেমপ্রান্তরের নাম, তেমনি শামসুর রাহমানের স্মৃতি ও সৃজন-সমুজ্জ্বল শ্যামলীর কবিঘর যেন তাঁর বইয়ের শিরোনামের মতোই যথার্থ এক ‘মেঘলোকে মনোজ নিবাস’।

তবু শ্যামলীর বাড়িতেই যেন পেয়েছেন শ্যামলিমা শুশ্রূষা। কবির প্রয়াণের পাঁচ বছর পর প্রিয়তমা স্ত্রী জোহরা রাহমানও এই বাড়ি ছেড়ে অনন্তের পথে পাড়ি জমান। এখন তাঁর শূন্য বাসঘরে, বইয়ের সংগ্রহে, ছবির ফ্রেমে আর লেখার টেবিলে শূন্যতা খেলা করে। প্রিয় পুত্র ফাইয়াজ, পুত্রবধূ টিয়া, দুই পৌত্রী নয়না আর দীপিতা কবিহীন গোধূলিবেলায়ও বাড়িটায় খুঁজে পান কবিরই সত্তাসূর্যের ঘ্রাণ।

আর কবি নিজে তো আজ থেকে ২৫ বছর আগে ১৯৯৪-এ ‘শ্যামলীর গালিব’ কবিতায় বলে গেছেন:

‘ভোরের আবীর ঝরে নিরিবিলি শ্যামলীর সুপ্ত/ গালিবের সত্তাময়। খোঁয়ারির তীরে জেগে উঠে/ তিনি নিশীথের কাছে পাওয়া গজলের রাঙা ওড়না/ খোঁজেন হাতের কাছে। ইজারবন্দের গিঁট খুলে/ খুলে পদাবলি পেয়ে যান, কিছু চুমকি-খসা ওড়না পড়ে উল্লসিত রাধাচূড়া গাছে, বাংলার আকাশে।’

কবি মির্জা গালিবের সৃষ্টিসূত্রে দিল্লির বিল্লিমারান মহল্লার ঘর যেমন আজ এক প্রশস্ত প্রেমপ্রান্তরের নাম, তেমনি শামসুর রাহমানের স্মৃতি ও সৃজন-সমুজ্জ্বল শ্যামলীর কবিঘর যেন তাঁর বইয়ের শিরোনামের মতোই যথার্থ এক ‘মেঘলোকে মনোজ নিবাস’।


লেখক, কবি ও প্রাবন্ধিক