মহামারি মোকাবিলার কাজে গতি নেই
করোনা মহামারি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান কোনো জোরালো কাজ চোখে পড়ছে না। ১২ আগস্ট থেকে স্বাস্থ্য সংবাদ বুলেটিন বন্ধ হওয়ার পর পরিস্থিতি সম্পর্কে সরাসরি কিছু জানতে পারছে না সাধারণ মানুষ। সংক্রমণ পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা অস্পষ্ট। এ বিষয়ে যে জরিপ হয়েছে তারও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সরকার প্রকাশ করছে না।
দেশে এ পর্যন্ত কত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, সরকার তা বলতে পারছে না। তবে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জরিপ বলছে, ঢাকা শহরের আনুমানিক ৯ শতাংশ মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। সংখ্যার হিসাবে তা ১৬ লাখের বেশি।
করোনা মহামারি মোকাবিলার কিছু কাজ ধীরগতিতে হচ্ছে। কিছু কাজ থেমে আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন এনে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে পারেনি সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাত গুটিয়ে নেওয়ার এই মনোভাব ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
মহামারি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান কোনো জোরালো কাজ চোখে পড়ছে না। ১২ আগস্ট থেকে স্বাস্থ্য সংবাদ বুলেটিন বন্ধ হওয়ার পর পরিস্থিতি সম্পর্কে সরাসরি কিছু জানতে পারছে না সাধারণ মানুষ। সংক্রমণ পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা অস্পষ্ট। এ বিষয়ে যে জরিপ হয়েছে তারও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সরকার প্রকাশ করছে না। অফিস-আদালতে যাওয়া, কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়া, প্রয়োজনীয় কাজে ঘরের বাইরে যাওয়া—এসব বিষয়ে বহু মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
মহামারি মোকাবিলার কাজে শুরু থেকে যুক্ত আছেন, এমন একজন সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য খাত শুদ্ধীকরণ বা ঢেলে সাজানোর উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে সদ্য বদলীকৃত বা পদায়নকৃত অধিকাংশ কর্মকর্তার জনস্বাস্থ্য বিষয়ে কাজের অভিজ্ঞতা নেই। তাই সংক্রমণ প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণে কেউ কেউ খেই হারিয়ে ফেলছেন, কেউ কাজ শুরু করতে ভয় পাচ্ছেন।
দেশে এখন সংক্রমণের ষষ্ঠ মাস চলছে। এরই মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালক (হাসপাতাল), পরিচালক (পরিকল্পনা)—এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন হয়েছে।
দেশে এ পর্যন্ত কত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, সরকার তা বলতে পারছে না। তবে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জরিপ বলছে, ঢাকা শহরের আনুমানিক ৯ শতাংশ মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। সংখ্যার হিসাবে তা ১৬ লাখের বেশি। অন্যদিকে এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করাতে পেরেছেন ১৩ লাখ ৪১ হাজার ৬৪৮ জন মানুষ। এর মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৫২৫ জনের। তাঁদের মধ্যে মারা গেছেন ৩ হাজার ৬২৫ জন। প্রায় দুই হাজার মানুষ করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।
মহামারি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অধিদপ্তরের কাজগুলো আমরা দ্রুততার সঙ্গে করার চেষ্টা করছি।’
থেমে থাকা কাজ
মহামারি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘বাংলাদেশ প্যানডেমিক রেসপন্স প্ল্যান’ তৈরি করে। এ দলিলটি নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করার প্রয়োজন হয়। এই পরিকল্পনা দলিলের জুলাই সংস্করণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেওয়ার পর তা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কোনো কৌশলপত্র বা কোনো সভা এখনো হয়নি বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে।
মহামারি মোকাবিলার কাজ তদারক করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মোট ১০টি কমিটি আছে। কাজের সমন্বয় বাড়াতে সপ্তাহে পাঁচ দিন এসব কমিটির সভা হতো। এসব সভা অনেকটাই বন্ধ আছে। অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ২৬ জুলাই দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর উপস্থিতিতে গতকাল পর্যন্ত এসব কমিটির মাত্র একটি সভা হয়েছে।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে জুন মাসের প্রথম দিকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে শহরগুলোতে ‘লকডাউন’ (অবরুদ্ধ) করা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। এ বিষয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জনদের কাছে এ বিষয়ে নির্দেশনাও পাঠানো হয়। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা ও লকডাউন করার বিষয়ে এখন কোনো কাজ হচ্ছে না।
দেশে পরীক্ষা কম হওয়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। দেশে মোট ৮৭টি কেন্দ্রে এখন করোনার নমুনা পরীক্ষা হয়। জনসংখ্যার অনুপাতে দৈনিক ২৪ হাজার নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু একদিনও ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। অনেকে মনে করেন, দ্রুত ও সহজে ফল জানার পরীক্ষার (র্যাপিড টেস্ট)অনুমোদন পেলে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়বে। অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ‘রেপিড টেস্ট’ বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করে ৯ জুলাই মন্ত্রণালয় পাঠায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ১০ দিন পর মন্ত্রণালয় অধ্যাপক লিয়াকত আলীকে সভাপতি করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে এবং নমুনা পরীক্ষা সম্প্রসারণ নীতিমালার ওপর মতামত দেওয়ার জন্য দশ কর্মদিবস ঠিক করে দেয়। বিশেষজ্ঞ কমিটি ৪ আগস্ট মতামতসহ নমুনা পরীক্ষা সম্প্রসারণ নীতিমালা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের দপ্তরে পাঠিয়েছে। এ নিয়ে সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে। করোনায় মৃত্যু কমিয়ে আনার বিশেষ কোনো উদ্যোগের কথাও শোনা যায়নি।
সূত্র বলছে, বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসাসেবার মূল্য নির্ধারণ বিশেষ করে অক্সিজেনের মূল্য নির্ধারণ বিষয়টিও ঝুলে আছে। এ বিষয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকদের সঙ্গে অধিদপ্তরের একাধিক সভা হয়েছে। কোনো সুরাহা হয়নি। এ আলোচনা এখন অনেকটাই থেমে আছে।
এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো না হওয়ার কারণে নমুনা সংগ্রহ বা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ছে না। পাশাপাশি সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার কাজ বা কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংও খুব কম হচ্ছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সঙ্গনিরোধ বা অবরুদ্ধ করার বিষয়ে জোর তৎপরতা সরকারি পর্যায়ে নেই। একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, পৃথিবীর একাধিক দেশে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হতে দেখা গেছে। বাংলাদেশেরও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার ব্যাপারে সরকার কিছু বলছে না। সংক্রমণের ঝুঁকি না থাকলে সরকারকে স্পষ্ট করে ‘নতুন স্বাভাবিক’ জীবনে ফেরার কথা বলতে হবে। সংক্রমণ থাকবে, সংক্রমণ নিয়েই আমাদের চলতে হবে।’
দৃষ্টি বৈঠকের দিকে
গত সপ্তাহে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, এ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে টিকার ট্রায়ালের (পরীক্ষামূলক প্রয়োগ) ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আজ-কাল এই বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বিশ্ববাসীর মতো বাংলাদেশের মানুষও করোনার টিকার দিকে তাকিয়ে আছে। চীনের কোম্পানি সিনোভ্যাকের টিকার ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে আইসিডিডিআরবি। তারা ইতিমধ্যে ট্রায়ালের নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের কাছ থেকে।
১২ আগস্ট ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে চীনের টিকার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হলে চীন বাংলাদেশের কত মানুষের ওপর ট্রায়াল করবে, এ ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশকে কত টাকা দেবে, চীন কী শর্তে বাংলাদেশকে টিকা দেবে—এসব নিয়ে আলোচনা হবে।
এ ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের টিকার ব্যাপারে ওই দিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরাও এসব কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আগামী সপ্তাহে একটি বৈঠক রয়েছে। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা কিংবা এদের অগ্রিম অর্থ দেওয়ার বিষয়ে ওই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, টিকার ব্যাপারে সরকারের নীতি পরিষ্কার না। অন্য কোম্পানির টিকার জন্য অগ্রিম অর্থ দেওয়ার কথা হচ্ছে। আর চীনের টিকা ট্রায়ালের জন্য টাকা চাওয়া হচ্ছে। টাকা নিয়ে চীনের টিকার ট্রায়াল হলে তার প্রভাব পড়ার ঝুঁকি আছে ট্রায়ালের ফলাফলের ওপর।
ইতিবাচক পরামর্শ
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার ফি বাতিল করার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি এই ফি বাতিল করার পক্ষে মত দিয়েছে। কমিটি বলেছে, বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হলে ৩০০ টাকা ফি দিতে হবে। অন্য সব ক্ষেত্রে পরীক্ষা বিনা মূল্যে হবে।
অন্যদিকে অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষা শুরু করা দরকার বলে মত দিয়েছে পরামর্শক কমিটি। সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে টিকার প্রসঙ্গের পাশাপাশি পরীক্ষার ফি ও অ্যান্টিবডি-অ্যান্টিজেন পরীক্ষার বিষয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে এ বিষয়ে পরামর্শক কমিটির সভাপতি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত তিন সপ্তাহের তথ্য দেখে বলা যায়, সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি আর নেই। সংক্রমণ এখন স্থিতাবস্থায় বা কিছুটা কমের দিকে। তবে এতে আত্মতুষ্টিতে থাকার কোনো সুযোগ নেই।’