তিনি হতে চেয়েছিলেন প্রধান শিরোনাম

শিল্পী মুর্তজা বশীর। জন্ম: ১৭ আগস্ট ১৯৩২। মৃত্যু: ১৫ আগস্ট ২০২০। গত বছরের ১৭ আগস্ট রাজধানীর মনিপুরি পাড়ার নিজ বাসভবনে।ছবি: খালেদ সরকার

সকালে একটি ফোন ওলট-পালট করে দিল দিনটাকে। মুর্তজা বশীর আর নেই। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বৃহস্পতিবার রাতে। শনিবার সকালেই তিনি চলে গেলেন। করোনাকাল আর পার করতে পারলেন না।

কামাল লোহানী যেদিন মারা গেলেন, সেদিন ২০ জুন, দীর্ঘক্ষণ ফোনে কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। সেই প্রবল তারুণ্যদীপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘চলে এসো, গল্প করা যাবে।’

করোনার প্রাদুর্ভাব কেটে গেলে আসব, এ কথা বলেছি।

কয়েক বছর ধরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁর কথা শোনার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। একই কথার পুনরাবৃত্তি যেমন হয়েছে, তেমনি কখনো কখনো বেরিয়ে এসেছে তাঁর জীবনদর্শন।

প্রধান শিরোনাম

একটি গল্প তিনি প্রায়ই বলতেন। ১৯৮০–র দশকের শুরুর দিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান এক ইতিহাসবিদ মারা গেলে একটি ইংরেজি পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছোট একটি শোক সংবাদ ছাপা হয়েছিল। চিন্তিত হয়ে তিনি কয়েকটি খবরের কাগজে খোঁজ নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আমি মরে গেলে নিউজটা কোথায় দেবেন?’

কেউ বললেন, ভেতরের পাতা; কেউ বললেন, শেষ পাতায়। শুধু দৈনিক বাংলা থেকে বলা হলো, প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলাম হবে তাঁর মৃত্যুসংবাদ। তিনি ঠিক করলেন, তত দিন বাঁচতে হবে, যত দিন পর্যন্ত না মারা গেলে পত্রিকার শিরোনাম হতে পারেন।

এ কথা বলার পর তিনি চলে যেতেন বগুড়ায় থাকাকালের একটি ঘটনায়। পড়েন করোনেশন ইনস্টিটিউশনে। ১৯৪৮ বা ’৪৯ সাল। স্কুলের পাশেই এক বন্ধুর বাড়ি। বন্ধু কাঁধে একটা গামছা নিয়ে বললেন, ‘ঘুরে বেড়াও। আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি।’

কয়েক বছর ধরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁর কথা শোনার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। একই কথার পুনরাবৃত্তি যেমন হয়েছে, তেমনি কখনো কখনো বেরিয়ে এসেছে তাঁর জীবনদর্শন।

প্রধান শিরোনাম

একটি গল্প তিনি প্রায়ই বলতেন। ১৯৮০–র দশকের শুরুর দিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান এক ইতিহাসবিদ মারা গেলে একটি ইংরেজি পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছোট একটি শোক সংবাদ ছাপা হয়েছিল। চিন্তিত হয়ে তিনি কয়েকটি খবরের কাগজে খোঁজ নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আমি মরে গেলে নিউজটা কোথায় দেবেন?’

কেউ বললেন, ভেতরের পাতা; কেউ বললেন, শেষ পাতায়। শুধু দৈনিক বাংলা থেকে বলা হলো, প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলাম হবে তাঁর মৃত্যুসংবাদ। তিনি ঠিক করলেন, তত দিন বাঁচতে হবে, যত দিন পর্যন্ত না মারা গেলে পত্রিকার শিরোনাম হতে পারেন।

এ কথা বলার পর তিনি চলে যেতেন বগুড়ায় থাকাকালের একটি ঘটনায়। পড়েন করোনেশন ইনস্টিটিউশনে। ১৯৪৮ বা ’৪৯ সাল। স্কুলের পাশেই এক বন্ধুর বাড়ি। বন্ধু কাঁধে একটা গামছা নিয়ে বললেন, ‘ঘুরে বেড়াও। আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি।’

বাঁচার মতো বাঁচা

‘আমার বয়স কত, বলতে পারো?’ প্রশ্নটা করে নিজেই বলেন, ‘১৯৩২ সাল থেকে হিসাব করো, তাহলেই বুঝবে।’

কিন্তু আপনাকে অতটা বয়সী বলে মনে হয় না।

‘শোনো, মানুষ কোনো না কোনো কিছুর ভিতর দিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। সময়কে যদি কেউ তার কাজ দিয়ে পার হতে না পারে—সেটা কবিতা, উপন্যাস, শিল্পকলা, আলোকচিত্র, যা–ই হোক—তাহলে সে বেঁচে থাকবে না।’

তারপর আরও জোর দিয়ে বললেন, ‘আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে কোন বিষয়টা জানো? আকাঙ্ক্ষা। যখন ছোট ক্লাসে পড়ি, দেখতাম বাবার কাছে রবীন্দ্রনাথের চিঠি। রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী আমার বাবাকে চিনত। ভাবতাম, আমি বাবার মতো হব। আমার নানা আকাঙ্ক্ষাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমার অটোগ্রাফ জমানো ছিল। জওহরলাল নেহরু, কাশ্মীরের শেখ আবদুল্লাহ, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণকে চিঠি লিখেছি। প্রথম বাঙালি ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের অটোগ্রাফ আছে আমার কাছে। বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার ছোটবেলা থেকেই ছিল।’

ছবি আঁকার বিষয়টা কি বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন? প্রশ্ন করি।

‘না। সেটা এসেছে মায়ের কাছ থেকে। মা বলতেন, বকুল, দ্যাখ (আমার ডাকনাম বকুল), মেঘগুলো দ্যাখ, যেন গরুর পাল যাচ্ছে। এই কল্পনাটাই আমাকে সাহায্য করেছে। ১৯৬০ সালে আমি যখন লাহোরে, অচেনা জায়গা, খালি গায়ে মেঝেতে শুয়ে আছি। হঠাৎ দেখি পানি চুইয়ে দেয়ালে আকার নিয়েছে একটা চেহারা। মা যেমন বলেছিল, আমিও সে রকম খুঁজতাম।’

বিশ্বাস ছিল বিখ্যাত হব

১৯৫০ সালের কথা। তিনি হাজং–তেলেঙ্গানা–কাকদ্বীপ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। পুলিশ খুব অত্যাচার করেছিল। ভুরু কেটে গিয়েছিল মারে। তিনি তখন জুলিয়াস ফুচিকের কথা ভেবে সহ্য করেছেন। এরপর জামিনে মুক্তি পেলেন। পত্রিকায় সংবাদ এল, ‘মুর্তজা রিলিজড অন বেইল।’

তিনি বললেন, ‘ওই কাগজটা আছে আমার কাছে। আমার কেন যেন বিশ্বাস ছিল, একদিন বিখ্যাত হব। ইতালিতে আমার বান্ধবী মারিয়া স্তুয়ার্দা ভ্যারিত্তি…’

ইতালিয়ান উচ্চারণে ভ্যারিত্তি না ভারিত্তি? প্রশ্নটা করাতেই কথা পাল্টে গেল।

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি বললেন, ‘বিয়ের রাতে মারিয়ার ছবি আমি দেখিয়েছি আমার স্ত্রীকে। বলেছি, এটা আমার অতীত। ভবিষ্যৎ তুমি। চাইলে আমি ওটা নষ্ট করে ফেলতে পারতাম, লুকাতে পারতাম, কিন্তু করিনি। মারিয়ার সঙ্গে আমার ছবি ছাপা হয়েছে তো! রোমে হাতে হাত ধরে বসে আছি।’

স্ত্রীর জন্য

স্ত্রীর জীবনের অসুস্থ শেষ বছরগুলোয় মুর্তজা বশীর সময় দিয়েছেন অকুণ্ঠভাবে। সন্তানদের বলেছেন, ‘তোমার আম্মার চিকিৎসার জন্য এই অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করতে হলেও করব। সে শুনে ফেলে। সম্ভবত তার মনে হয়েছিল, বেঁচে থাকার আর কোনো মানে হয় না। তবে এসব তো আবেগের কথা। অ্যাপার্টমেন্ট বেঁচে দিলে এই ফ্রিজ, এই আলমারি—এসব কোথায় রাখতাম? আমার তো বাপের বাড়ি বা গ্রামের বাড়ি নেই। আবেগ আর বাস্তবের জীবন আলাদা।’

শেষ কথার প্রতিধ্বনি

শেষ যে কথাগুলো মুর্তজা বশীর বলেছিলেন, এখনো তা কানে ভাসে। তিনি বলছিলেন, ‘আমি কিন্তু এখনো সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখি। বৈষম্য যতই প্রকট হবে, ততই তা ঘনিয়ে আসবে। আমি তো চাই ঢাকা আরও উন্নতি করুক। এই বৈষম্য তখন আরও প্রকট হয়ে ফুটে উঠবে। বাংলাদেশ কী, সেটা বোঝার জন্য তোমাকে যেতে হবে হাসপাতালের শিশু বিভাগে। বড় বড় মাথা, চোখ বড় বড়, কিন্তু শরীর অপুষ্টিতে কাতর। ঢাকা শহর বাংলাদেশ নয়। ৮৭ বছর বয়সে এসে আমি এ কথা বলছি। হয়তো আমি বেঁচে থাকব না, কিন্তু বিপ্লব হবে।’

২০ জুন বলেছিলেন, ‘সামনেই তো আগস্ট। তুমি আসবে না?’

কয়েক বছর ধরে ১৭ আগস্ট জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর বাড়ি যাওয়া নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিলাম, করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে আসব। নইলে টেলিফোনে কথা হবে।

করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। মণিপুরীপাড়ার বাড়িটিতে টেলিফোনও করা হলো না আর।