>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
মা আর স্ত্রী নিয়ে আমার ছোট সংসার। বাবা বাড়ি করে গিয়েছিলেন। সে বাড়িতেই থাকি। তিনটি ঘর। উত্তর দিকের ঘরটা আমাদের প্রয়োজন হয় না। তাই ভাড়া দিয়ে রেখেছি। ভাড়া বাবদ মাসে দেড় হাজার টাকা পাই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়াম মার্কেটে আমার আরও আছে একটা ফটোকপির দোকান। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের জন্য কিছু খাতা–কলমও রাখি। এক হাতে এসব সামলাই।
দোকান আর ঘরভাড়া থেকে যতটুকু আয় হয়, তা দিয়ে আমাদের ছোট্ট সংসারটা চলে যায়। তবে গত কয়েক মাসে আমাদের সংসার খরচ সামান্য বেড়েছে। কারণ, সামনে আমাদের সংসারটা আরেকটু বড় হবে। নতুন অতিথি আসছে। আমার স্ত্রী মা হতে চলেছে। সে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ফলে তার সুস্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ভালো–মন্দ খাবারদাবারের দিকে স্বাভাবিকভাবেই একটু লক্ষ রাখতে হয়।
নতুন অতিথির আগমন–সংবাদ মনে হচ্ছে আমার মধ্যেও কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। শুধু যে আনন্দেই আত্মহারা হয়েছি, তা নয়। কেমন একটা দায়িত্ববোধও যেন এসে পড়েছে। একটা চালিকাশক্তির উন্মেষ ঘটেছে নিজের ভেতরে। ঘুম একটু কমেছে বটে, তবে গপ্পোবাজি কমে এসেছে। বিকেলের ক্রিকেট খেলাটাও কমিয়ে এনেছি। দোকানে মনোযোগ বেড়েছে। মনটা জুড়ে আছে শুধু সংসার আর দোকান। এত দিন সেভাবে টাকা জমাইনি। এখন জমাতে হবে। সামনের দিনগুলোর জন্য সঞ্চয়ের দরকার আছে।
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। যেমনটা চেয়েছিলাম। করোনাভাইরাস এসে ছন্দপতন ঘটিয়ে দিল। প্রথম ছেদ পড়ল মার্চ মাসের দ্বিতীয় ভাগে। সামাজিক সংক্রমণ রোধ করার জন্য সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিল। বন্ধ হয়ে গেল অফিস–আদালত। তার ফলে ফটোকপি করার চাপও গেল কমে। বন্ধ হয়ে গেল খাতা–কলমের বিক্রি। প্রথমে আয় কমল। তারপর তো পুরোপুরিই বন্ধ।
২৬ মার্চ থেকে ছুটির পর দফায় দফায় ছুটি বেড়ে এখন মাস গড়িয়ে এল। ছুটি হলো ঠিকই। কিন্তু পরিস্থিতির তো কোনোই উন্নতি দেখছি না। বরং উত্তরোত্তর খারাপ হচ্ছে। দিন দিন ক্রমিক অবনতি। একের পর এক জায়গা লকডাউন হচ্ছে। বেড়ে চলেছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে উঠেছে। আশার আলো তো খুব দেখতে পাচ্ছি না।
শুনতে পেয়েছি, রাজশাহীর পুঠিয়ায় করোনায় আক্রান্ত রোগীর দেখা মিলেছে। রাজশাহীতে কখন কোথায় লকডাউন শুরু হয়, কে জানে। যে টাকা জমিয়েছিলাম, তার দুই–তৃতীয়াংশ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। স্ত্রীকে ডাক্তার দেখানোর তারিখ এগিয়ে আসছে। এটা তো খুবই জরুরি একটা খরচ। কিন্তু সামনে তো সবকিছু অনিশ্চিত। জমানো টাকা শেষ হলে হাত দিতে হবে ব্যবসার মূলধনে। আল্লাহ্ রহম করো।
আমাদের সন্তানের জন্ম হবে আর মাসখানেক পরে। জানি না, ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রথমেই পৃথিবীর কোন চেহারাটা ও দেখবে। করোনার প্রকোপ কি তত দিনে একটু কমবে না? পৃথিবী সামান্য হলেও নিরাময়ের দিকে এগোবে না?