এখনো ধরা পড়ছে মা ইলিশ
ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে গত ৩০ অক্টোবর। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার চার সপ্তাহ পরও খুলনার বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ডিমভর্তি মা ইলিশ। প্রথম দিকে প্রায় শতভাগ ডিমওয়ালা ইলিশ বাজারে পাওয়া গেলেও বর্তমানে বাজারে আসা ডিমওয়ালা ইলিশের পরিমাণ কম।
নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার প্রথম দুই সপ্তাহে খুলনার বিভিন্ন বাজারে ওঠা অধিকাংশ ইলিশের পেটই ছিল ডিমে ঠাসা। তবে ইলিশ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ডিমওয়ালা ইলিশ কমে গেছে। প্রথম দিকে বাজারে এত ডিমওয়ালা ইলিশ পাওয়া যাওয়ায় বিস্মিত হয়েছেন তাঁরা।
ইলিশ ব্যবসায়ী ও গবেষকেরা বলছেন, বর্তমান ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার যে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, ওই সময়ের মধ্যে মা ইলিশ ডিম ছাড়তে পারছে না। এ কারণে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর জেলেদের জালে ধরা পড়েছে ডিমওয়ালা ইলিশ। এমন পরিস্থিতিতে ইলিশের প্রকৃত প্রজনন মৌসুম নতুন করে নির্ধারণ করার দাবি জানান তাঁরা। তাঁদের মতে, বাজারে ডিমওয়ালা ইলিশের দাম তুলনামূলক অনেক কম।
গবেষকেরা বলেন, এবার যে পরিমাণ ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা পড়েছে, তাতে ভবিষ্যতে ইলিশের উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিভিন্ন সময় নিষেধাজ্ঞা জারি করে বাংলাদেশ ইলিশের ক্ষেত্রে যেভাবে এগিয়েছে, তাতে প্রকৃত প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করতে না পারলে আবার আগের মতোই ইলিশসংকটে ভুগতে হবে।
এ বছর সরকারিভাবে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা ঠিক করা হয় ৯ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত। কাগজ-কলমে শীর্ষ প্রজনন মৌসুম শেষ হওয়ার পরও এত পরিমাণ ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা পড়ায় বিষয়টি ইলিশ গবেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে। সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা ও জরিপেও ওই বিষয়টি উঠে এসেছে।
গত এক বছরব্যাপী চলা ওই গবেষণা ও জরিপে দেখা গেছে, গত বছর নিষেধাজ্ঞার সময় ৩০ শতাংশের বেশি মা ইলিশ ডিম ছাড়লেও এ বছর ডিম ছাড়ার হার অত্যন্ত কম। খুলনার মাছের বাজারগুলো থেকে প্রাপ্ত মা ইলিশ ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন নদী থেকে ধরা ইলিশের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে মাত্র ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ ইলিশ ডিম ছেড়েছে এবং বাকি ৮০ শতাংশ মাছ এখনো ডিম ছাড়েনি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম নির্ণয় নিয়ে গবেষণা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) শিক্ষক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী। গবেষণাটির অর্থায়ন করছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সেল। গবেষণাটি চলবে আরও এক বছর। গবেষণা শেষে ইলিশ মাছের প্রধান প্রজনন মৌসুম নিরূপণে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যাবে বলে মনে করছেন ইউসুফ আলী।
জানতে চাইলে ওই গবেষক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর দুই সপ্তাহ ধরে খুলনার বিভিন্ন বাজার থেকে ইলিশ মাছের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। দেখা যায়, মাছগুলোর অধিকাংশ ডিমের পরিপক্বতা শেষ পর্যায়ে। ডিমের আকার পরিমাপ করে দেখা যায়, ডিমগুলোর আকার একেবারে চূড়ান্ত পরিপক্বতার কাছাকাছি অবস্থান করছে। এগুলো আর এক থেকে দুই সপ্তাহ পরেই ডিম ছাড়ত।’
তিনি মনে করেন, ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় ২২ দিন থেকে বাড়িয়ে ৩৪ দিন করা উচিত। এতে দুটি ভরা পূর্ণিমা ও একটি অমাবস্যার গোনে অধিকাংশ পরিপক্ব মা ইলিশ ডিম পাড়ার সুযোগ পাবে। নিষেধাজ্ঞার সময়ে সরকারকে অবশ্যই জেলেদের আরও বেশি ভর্তুকি দেওয়া উচিত।
খুলনার একমাত্র মৎস্য অবতরণকেন্দ্রটি অবস্থিত নগরের ৫ নম্বর ঘাট এলাকায়। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন ওই কেন্দ্রটি নিয়ন্ত্রণ করে। ওই ঘাটে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ইলিশ আসে। বেশির ভাগ ইলিশ আসে বরিশাল, পাথরঘাটা, পটুয়াখালী, বরগুনা এলাকা থেকে।
খুলনা মৎস্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ হাওলাদার বলেন, এবার হয়তো ইলিশের সঠিক প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করতে না পারায় নিষেধাজ্ঞার পর যে ইলিশ এসেছে, তার বেশির ভাগই ডিমওয়ালা। তবে মাসের শেষের দিকে ডিমওয়ালা ইলিশ আসা কমে গেছে।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন খুলনার ব্যবস্থাপক মো. জাহিদুল ইসলাম মনে করেন, ইলিশের প্রজনন মৌসুম আরও কিছুদিন বাড়িয়ে দিলে হয়তো ওই ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা পড়ত না।
জানতে চাইলে পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা ইমদাদুল্লাহ বলেন, পটুয়াখালীর ইলিশের প্রধান স্থান পায়রা, তেঁতুলিয়া ও রাসনাবাদ নদী। বড় ওই নদীগুলোতে এবার মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ইলিশ ডিম ছেড়েছে। আর কয়েক দিন সময় পেলে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সময় পেত। স্থানভেদে দেখা যাচ্ছে ইলিশের প্রজনন মৌসুম ভিন্ন হচ্ছে। এ কারণে গবেষণা করে স্থানভেদে ইলিশের প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খুলনা নগরের ময়লাপোতায় অবস্থিত কেসিসি সন্ধ্যা বাজারই হলো খুলনার সবচেয়ে বড় মাছের বাজার। ওই বাজারে দীর্ঘদিন ধরে মাছ
ব্যবসা করছেন মো. সাইফুল শেখ। তিনি বলেন, এবারই সবচেয়ে বেশি ডিমওয়ালা মা ইলিশ বাজারে এসেছে। ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় আরও
বাড়ানো দরকার।
জানতে চাইলে খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবু ছাইদ বলেন, এবার বাজারে প্রচুর ডিমওয়ালা ইলিশ দেখে মৎস্য বিভাগও বিষয়টি নিয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে।