ঋণের চক্রে কৃষকের হাঁসফাঁস, অনেকে আছেন 'বন্ধকি শ্রমে'
তিন বছর আগে বোরো মৌসুমে আগাম বন্যায় কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার ফসল বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরের দুই বছর ফলন ভালো হলেও ধানের ন্যায্যমূল্য পাননি কৃষক। তাঁরা এলাকার মহাজন, বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে একের পর এক ঋণ নিয়েছেন। সেই ঋণের জাল থেকে বের হতে পারেননি হাওরবেষ্টিত উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী ও করিমগঞ্জের কৃষক।
ঋণগ্রস্ত কেউ নিজে, কেউ সন্তানকে ঋণদাতা মহাজনের কাছে ‘বদ্ধ’ রেখেছেন। তাঁরা ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত অনেকটা শ্রমদাসের মতো মহাজনের ইচ্ছা অনুযায়ী শ্রম দেন। আবার অনেকে অভাবে পড়ে অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে বদ্ধ (বন্ধকি শ্রমিক) হন নির্দিষ্ট টাকা ও ধানের বিনিময়ে।
এদিকে হাওর এলাকার একমাত্র ফসল বোরো চাষের মৌসুম এখন। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বীজতলা তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা। এবার হাওরের পানি দেরিতে নামায় বেশির ভাগ জায়গায় সেই কাজ এখনো শুরু হয়নি। এর মধ্যে ঋণগ্রস্ত অনেক কৃষক ও কৃষিশ্রমিক অন্য কাজের আশায় আশপাশের জেলা ও রাজধানীমুখী হয়েছেন।
সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের পাঁচ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে শতাধিক কৃষক, বর্গাচাষি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে কৃষকের এই দুর্দশার কথা জানা গেছে। কিশোরগঞ্জের জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী ও করিমগঞ্জ উপজেলায় মোট কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ লাখ ৬৯ হাজার ১৪৮টি। এর মধ্যে মাঝারি, ক্ষুদ্র ও ভূমিহীন চাষির সংখ্যাই বেশি। এসব উপজেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৯২ হাজার ৩৯৫ হেক্টর। এই পাঁচ উপজেলায় চলতি মৌসুমে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৯৭০ মেট্রিক টন, যা জেলার মোট বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার ৫৫ শতাংশ।
>
- মহাজনি ঋণে ৫০% (আট মাসে বছর)
- এনজিওর ১২.৫০-১৩.৫০%
- ব্যাংকের কৃষিঋণে ৮.৫০%
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য থেকে জানা যায়, তিন বছর আগে ২০১৬-১৭ মৌসুমে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নষ্ট হয় ৫৫ হাজার ৮৪৫ হেক্টর জমির প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন ধান। ক্ষতিগ্রস্ত হন ১ লাখের অধিক কৃষক। এর পরের দুই মৌসুমে উৎপাদন ভালো হলেও কৃষক বলছেন, তাঁরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাননি। ফলে আগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেননি। এই অবস্থায় মহাজনদের থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে অনেকে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন। সেই ঋণ শোধ করতে ঋণ নিয়েছেন ব্যাংক থেকে। এভাবে ঋণের চক্রে পড়েছেন তাঁরা।
সরেজমিন চিত্র
কিশোরগঞ্জ সদর থেকে হাওর এলাকায় ঢুকতে প্রথমে যেতে হবে শহর থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বে চামড়াবন্দর এলাকায়। সেখান থেকে উত্তর দিকে ট্রলারে করে ১২ নভেম্বর পৌঁছানো গেল ইটনা উপজেলার বড়িবাড়ি ইউনিয়নের টিয়ারকোনা গ্রামে। ধনু নদীর তীর ধরে যেতে যেতে একদল কৃষককে অপেক্ষাকৃত উঁচু একটা জমিতে কাজ করতে দেখা যায়। কথা হয় গ্রামের আমিনুল হক, সরফুদ্দি মিয়া, এমাদ খানসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা তখন সেখানে মিষ্টিকুমড়া চাষের জন্য জমি তৈরি করছিলেন। বোরো চাষের খবর জানতে চাইলে কৃষক আমিনুল হক বললেন, ‘ধান ফলায়া কি অইবো? ধানে দামই পাওয়া যায় না। তিন বৎসর আগে সেই যে ধান মাইর গেল হেই ক্ষতি এহনো পোষায়া ওডে নাই। এই গাঁওয়ে দুই শর বেশি ঘর আছে। বেশির ভাগই ঋণের বোঝা টানতাছে।’ এ সময় কৃষক এমাদ খান বললেন, ‘মহাজনের কাছ থেইক্যা ট্যাহা (টাকা) নিলে হাজারে পাঁচ শ ট্যাহা লাভ দেওন লাগে।’ ১ হাজার টাকায় ৫০০ টাকা সুদ দিতে হয় আট মাসে। মহাজনি ঋণে আট মাসে বছর। সুদের হার দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ।
পরদিন করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখোলা ঘাট থেকে রওনা হয়ে নিকলীর ভাটিভরাটিয়া গ্রামে পৌঁছাতে লাগে প্রায় আধা ঘণ্টা। এরপর কাশীপুর। সেখানকার আশকর আলী বলেন, ‘মহাজনের সুদের কোনো মা-বাপ নাই। এনজিওর ঋণ ঠিক সময়ে শোধ না করলে সুদ হাজারে হাজার টাকাতেও পৌঁছায়। আর ব্যাংকের ঋণ তো সবাই পায় না।’
কাশীপুর থেকে ট্রলারে চেপে মিঠামইন উপজেলার হাসানপুরে পৌঁছাতে লাগে ঘণ্টাখানেকের বেশি। মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে তীব্র রোদে ঝলসে ওঠা চাপালি মাছের ঝাঁক আর দিগন্ত বিস্তৃত হাওরের জায়গায় জায়গায় পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একাকী হিজলগাছ ও দ্বীপের মতো গ্রামগুলো। এই মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বাড়ি। হাসানপুরে নবনির্মিত সেতুর গোড়ায় কথা হয় কৃষক শাহেদ আলী, সুরুজ মিয়া ও মোহাম্মদ দুলাল মিয়ার সঙ্গে। তাঁরা বললেন, অনেক দিন হলো হাওর এলাকায় বিদ্যুৎ এসেছে। তৈরি হচ্ছে সড়ক, সেতু। কিন্তু এখানকার কৃষকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
সেখানে উপস্থিত গুপদীঘি ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আওলাদ মিয়া বলেন, ‘১ একর জমি রোপণ করলে খরচ হয় ২০ হাজার ট্যাকা। বৈশাখ মাসে ধানের দাম থাকে ৫০০ ট্যাকার মইধ্যে। অথচ এক মণ ধান ফলাইতে খরচই হয় ছয়-সাত শ ট্যাকা।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন অনেক ব্যক্তির পাশাপাশি গত কয়েক বছরে কিশোরগঞ্জ সদরেও অনেকে মহাজনি ঋণের কারবারে যুক্ত হয়েছেন। সুদের হার বেশি হলেও গরিব কৃষক এসব ব্যক্তির কাছে ঋণ নিতে যান সহজপ্রাপ্যতার কারণে। এনজিও বা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়াকে খানিকটা ঝামেলা মনে করেন অনেকে। আবার মহাজনের ঋণ সময়মতো শোধ করতে ব্যর্থ হয়ে অনেকে পরে এনজিও বা ব্যাংকঋণের জন্য ছোটেন। এক জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে অন্য জায়গার ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করেন। হাওরে কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনো আয়ের উৎস না থাকায় কৃষকের বড় অংশ এই ঋণের চক্র থেকে বের হতে পারে না।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরীও মহাজনি ঋণ নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছুদিন আগেই জেলা প্রশাসনের এক কর্মচারী আমার কাছে এসেছিল এ ধরনের একটা সমস্যা নিয়ে। সে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ করেছিল। ওই টাকা একসময় সুদে-আসলে ৫০ হাজার টাকায় পৌঁছায়। পরে ওই ঋণদাতা ব্যক্তিকে ডেকে সালিসের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করি।’
হাওর এলাকায় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালায় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, আশা ও পিপলস ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন (পপি)। এই তিন এনজিও থেকে গত এক বছরে ইটনা, অষ্টগ্রাম ও মিঠামইন উপজেলার ৩০ হাজারের বেশি কৃষক পরিবার ৮০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। বছরে সুদের হার সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে গত এক বছরে ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী উপজেলায় ৩ কোটি ১৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ করা হয়। ২৭টি ব্যাংক গত অর্থবছরে সারা জেলায় কৃষিঋণ দিয়েছে ২৮৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা। জেলা কৃষিঋণ কমিটির সদস্যসচিব ও কিশোরগঞ্জ অগ্রণী ব্যাংকের আঞ্চলিক শাখার উপমহাব্যবস্থাপক মো. সোলায়মান মোল্লা প্রথম আলোকে জানান, কমিটির মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণের সুদের হার সাড়ে ৮ শতাংশ। এর বাইরে স্থানীয় অনেকগুলো এনজিও ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে থাকে। তাদের দেওয়া ঋণের হিসাব পাওয়া যায়নি।
পপির জেলা সমন্বয়কারী মো. ফরিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, হাওর এলাকায় বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারলে ঋণের এই দুষ্টুচক্র থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে হাওরের ভূমি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনাটা জরুরি। তাঁর মতে, জলাভূমির ওপর কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা গেলে হয়তো তাঁদের আর্থিক দুর্দশা কিছুটা কাটবে।
এ যেন শ্রমদাস প্রথা
১২ নভেম্বর দুপুরে করিমগঞ্জের শেষ প্রান্তে ধনু নদীর পারে চংনোয়াগাঁও গ্রামের একটা গোচারণ ভূমিতে কথা হয় কিশোর রাজীবের সঙ্গে। চার-পাঁচ বছর আগে রাজীবের বাবা আবদুর রহমান এলাকার বালিখলা মৎস্য আড়ত সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা ধার করেছিলেন। তিনি জীবিত থাকতে সেই ঋণ শোধ করে যেতে পারেননি। এখন বাবার হয়ে কিশোর রাজীব বদ্ধ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে হাবিবুর রহমানের বাড়িতে। কিশোর রাজীব প্রথম আলোকে বলল, কয়েক বছর ধরেই এখানে কাজ করছে সে, বছরের কার্তিক মাস থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত। এতে কেবল সুদ পরিশোধ হচ্ছে। আসল টাকা কবে শোধ হবে, সেটা বুঝতে পারছে না সে।
একইভাবে ১৬ বছরের আরেক কিশোর হাশিমউদ্দীন বদ্ধ আছে করিমগঞ্জ উপজেলার সুতারপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশীদের বাড়িতে। চেয়ারম্যানের কাছ থেকে হাশিমউদ্দীনের বাবা শামসুল হক আড়াই লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। প্রতিবছর সেই টাকার সুদ আসে ১ লাখ টাকার বেশি। ছয় বছর ধরে হাশিমউদ্দীন সেই সুদের টাকা পরিশোধ করছে চেয়ারম্যানের বাড়িতে বদ্ধ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। গ্রামের লোকজন জানান, চেয়ারম্যানের বাড়িতে হাশিমউদ্দীন ছাড়া আরও দুই ব্যক্তি বদ্ধ আছেন।
হারুন অর রশীদ ঋণের বিপরীতে হাশিমউদ্দীনকে বদ্ধ রাখার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, ‘এলাকায় এ রকম বহু লোক আছে। ঋণের সুদ পরিশোধ করতে তারা অন্য ঘরে বদ্ধ থাকে। কিন্তু আমি টাকা ও ধান দিয়ে তিনটা ছেলেরে রাখছি।’ একই কথা বললেন রাজীবকে বদ্ধ রাখা বালিখলা মৎস্য আড়ত সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান।
কাশীপুর গ্রামের কৃষক নূর হোসেন জানান, তাঁর এক ছেলেকে ৯ মাসের জন্য এক গৃহস্থের বাড়িতে বদ্ধ রেখেছেন আগাম ২০ হাজার টাকা ও ২০ মণ ধানের বিনিময়ে। ধান পাবেন পরে। শ্রমদাসসুলভ এই প্রথার বিষয়ে জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের কেউ কিছু বলেনি। যদি এ ধরনের কোনো কিছু থেকেই থাকে তাহলে তা ভয়াবহ অন্যায়।’