রাজনীতিকে শুদ্ধ পথে আনার এটিই সময়
আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যা গোটা জাতিকে নাড়া দিয়েছে, আমাদের অসাড় হয়ে পড়া বিবেককে ঝাঁকুনি দিয়েছে। মানুষ যে আবেগপ্রবণ হয়ে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, তাকে অবশেষে বিবেকের জাগরণ হিসেবে গণ্য করা যায়। ছাত্রদের পাশাপাশি সারা দেশের মানুষ এ ঘটনার প্রতিবাদে, প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপনে শরিক না হয়ে পারছে না। এভাবে প্রাণের সাড়া ফিরে আসার অর্থ হলো সঠিক কাজটি করার সাহসও ফিরে পাওয়া। এই বাস্তবতায় ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ যদি আত্মরক্ষার গতানুগতিক পথ খুঁজতে থাকে, তাহলে সঠিক রাস্তায় এগোনোর সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।
স্বস্তির দিক হলো, প্রধানমন্ত্রী সঠিকভাবে সাড়া দিয়েছেন এবং ব্যবস্থা নিচ্ছেন। একই সঙ্গে তিনি দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন এবং আবরার হত্যাকাণ্ডের পরে অপরাধীদের দমনে তাঁর সরকারের দৃঢ়তারই প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর কথায় আবরারের জনক-জননীসহ জনগণ আস্থা রেখেছেন। তবু আমাদের ভয় হয়—অতীতের অভিজ্ঞতাই এর উৎস—ক্ষমতার নানা হিসাবের ফেরে অভিযান মাঝপথে না বন্ধ হয়ে যায়, বিচারপ্রক্রিয়া না অর্ধেক পথে গতি হারিয়ে ফেলে। এমন ঘটনা দেশ, গণতন্ত্র এবং আওয়ামী লীগ সবার জন্যই হবে দুর্ভাগ্যজনক। কেননা, বিগত দিনে নানা সূত্রে রাজনীতিতে যেসব নেতিবাচক উপাদান জড়ো হয়েছে, তা তো সাফ করতে হবে, নয়তো গণতন্ত্রের রাজনীতি মুক্ত হবে না, আইনের শাসন বা মানবাধিকারের মতো অ্যাজেন্ডাগুলোর বাস্তবায়ন পিছিয়ে যাবে।
আবরার হত্যার প্রেক্ষাপটে ছাত্ররাজনীতির নামে ছাত্রলীগের (শুনেছি অতীতে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরও এ কাজ করেছে) বর্তমান নেতা-কর্মীরা যেসব অপকর্ম করে চলেছেন, তার সম্পূর্ণ চিত্র প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় দেশজুড়ে ঘটা অনাচারের দায় দল কি এড়াতে পারে? কয়েকজন ব্যক্তি প্রশ্রয় ও আশ্রয় পেয়েছে দলে। তবু ভালো যে এখন মানুষের দাবি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি মিলে গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে নির্মমতার ঘাঁটিগুলো উচ্ছেদ হবে, অপরাধীদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে শাস্তির প্রতিশ্রুতিও মিলেছে। মনে রাখতে হবে, গণমানুষ ÿক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের রক্ত এবং ভারাক্রান্ত চোখের অশ্রু ঝরিয়ে সুষ্ঠু বিচারের এই আকুতি প্রকাশ করেছে। মানুষের রক্ত এবং অশ্রুর মর্যাদা যেন শাসকেরা রক্ষা করেন। এটি এ দেশেরই নিষ্পাপ নিরপরাধ এক তরুণের অন্যায়-অকারণ-নিষ্ঠুর আত্মত্যাগের প্রতি জাতির শ্রদ্ধার্ঘ্য। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে যে দানবীয় অমানবিক শক্তির উত্থান ঘটেছিল, তার বিরুদ্ধে ন্যায়, স্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তার সপক্ষে আবরার ফাহাদ এক ভিন্ন মাত্রার অনন্য প্রতীক। হ্যাঁ, দানবীয় অতীতের গর্ভ থেকে মানবিক ভবিষ্যৎ ছিনিয়ে আনার সংগ্রামের শহীদ আবরার ফাহাদ। তাঁর অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কোনো স্মারক বা তাঁরই পূর্ণাবয়ব ভাস্কর্য বুয়েটের চত্বরে দৃশ্যমান থাকলে সেটি উপযুক্ত কাজ হবে—অনাগতকালের কাছে মুক্তচিন্তা, বাক্স্বাধীনতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও গণতন্ত্রের বারতা পৌঁছে দেবে।
এখন আবরারের মৃত্যুতে প্রকাশ হয়ে পড়া আরব্ধ কাজগুলো শুরু করা যাক।
হ্যাঁ, আমরা তো জানি, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অনেক কলেজের ছাত্রাবাসেই ভয়ংকর নিপীড়নের কক্ষ ছিল—দশ বছর ধরে তো ছিলই, অনেক দিন ধরেই ছিল। যুবলীগ নেতাদের অপকর্ম ধরা পড়ার পর আরও টর্চার সেলের কথা জানা গেল। নারায়ণগঞ্জের কিশোর ত্বকী হত্যার সূত্রে এলাকার প্রভাবশালী পরিবারের ছেলেরও নিপীড়নকেন্দ্রের কথা আমাদের জানা হয়েছিল। তখন সবুজ সংকেত জ্বলেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, এখন ত্রাসের কলাকুশলীদের মুখোশ খসে গেছে। রাজনীতিক কিংবা পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এমনকি সাধারণ পাবলিকও বলতে পারবেন না আমি জানি না। এটি যেন হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলনের আরেকটি ভার্সন। হ্যাঁ, যারা দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা টর্চার সেলে পীড়ন-নির্যাতন-লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন, এবার তাঁদের মুখ খোলার সময়। সত্যিই তো, দেশ, জনগণ, এমনকি আওয়ামী লীগই-বা কেন এই ভার আর বহন করবে? কেনই-বা ছাত্রলীগ তার সুবর্ণ ঐতিহ্য রেখে বর্তমানের কদর্য বোঝা টানবে? কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন-রূপান্তরের সাহস এবং আত্মবিশ্বাস নিশ্চয় নেত্রী শেখ হাসিনার আছে। আর তা প্রয়োগের ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ এটিই।
অবশেষে সেই কথায় আসতে হয়, কেন উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত যারা ভদ্র স্বভাবের মেধাবী ছাত্র, তারা হঠাৎ নিষ্ঠুর অমানুষ হয়ে নৃশংসতায় উন্মত্ত হলো? আমি মনে করি, এ দায় মূলত শিক্ষা ও রাজনীতির। পরিবারের প্রসঙ্গ অবশ্যই আসবে, তবে এ–ও মানতে হবে, দেশের অধিকাংশ পরিবারের পক্ষে চলমান শিক্ষা ও রাজনীতির সংকট থেকে সন্তানকে বাঁচানোর সামর্থ্য নেই। বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রতিভা ও মানবিক গুণাবলির বিকাশে কোনো ভূমিকাই রাখছে না, আর রাজনীতি তাদের জন্য বখে যাওয়ার পথ খুলে দিচ্ছে এবং অপকর্মের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। ছাত্ররাজনীতির আচ্ছাদনেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে টর্চার রুম, গণরুমের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধী নয়ন বন্ডদের তো রাজনীতিই আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। আবার যুবা অপরাধী সম্রাট, খালেদরা তো সরাসরি যুবলীগেরই নেতা।
আজকের রাজনীতি—তা ছাত্র, যুবা, শ্রমিক বা মূল দলের রাজনীতি হোক—কোন পর্যায়ে আছে, তা বোঝা যাবে গত শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকে রাজনীতির সঙ্গে তুলনা করলে। তখন রাজনীতিতে আদর্শ ও মূল্যবোধের চর্চার কারণে তা ছিল জাতি ও দেশের কল্যাণে নিবেদিত। তখন লক্ষ্য ÿছিল মহৎ, স্বপ্ন ছিল বড় এবং এরই ফলাফল স্বাধীনতা। বিপরীতে আজ রাজনীতি একটি পেশা, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বৈষয়িক ভাগ্য পরিবর্তনেই প্রধান ভূমিকা রাখছে। একালে সফল রাজনীতিবিদদের ত্যাগের বিপরীতে বিত্ত ও ভোগের তুলনা করলেই তা বোঝা যাবে।
এদিকে একালের শিক্ষার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ফলাফল, যা ব্যক্তিই অর্জন করে, অর্থাৎ শৈশব থেকে শিক্ষার্থীরা নিজের স্বার্থ হাসিলে নিয়োজিত। ব্যক্তিগত স্বার্থ অনেকটা কৃষ্ণবিবরের মতো, সেটি যেমন সব আলো শুষে নেয়, এ–ও তেমনি মহৎ আদর্শ ও মানবিক সৎ গুণাবলির সব পাঠ ও কথার আলো সবটাই শুষে নেয় নম্বরের চাপ। তাদের অন্তরকে আলোকিত ও সমৃদ্ধ করার জন্য কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকে না। এমন ক্ষুদ্র লক্ষ্যের পাঠ স্মৃতির ভান্ডারে সঞ্চিত থাকতে পারে না। তার ওপর এখন ছোটবেলা থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পরপর পাবলিক পরীক্ষার বাধা ডিঙোতেই তো শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যায়। শিক্ষার্থী হলো শ্রেণিকক্ষ অনেকের সঙ্গে একজন আর পরীক্ষার্থী অনেকের মধ্যে একা একজন। পরীক্ষানির্ভরতার ফলে পুরো শিক্ষাজীবনে ভেতরে-ভেতরে তাদের একক যাত্রা, এ যেন ব্যক্তিগত সাফল্যের নিঃসঙ্গ লড়াই। আমরা একবারও ভাবিনি পরীক্ষার্থী ও শিক্ষার্থীতে পার্থক্য বিরাট। শিক্ষার্থী দলে চলতে পারে, পরীক্ষার্থী একাই লড়ে। শিক্ষক বা শিক্ষার্থী কারোরই বড় কিছু নিয়ে ভাবার ফুরসত নেই। ফলে রাজনীতি এবং শিক্ষা দুটির কোনোটিই কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের কোনো মহৎ আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না। উল্টো ÿক্ষুদ্র স্বার্থের নানা প্রলোভন দেখাতেই থাকে। আমরা তো আদতে কর্মফলই ভোগ করছি।
এ অবস্থায় বলতেই হচ্ছে শিক্ষা এবং রাজনীতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দল (সব অঙ্গসংগঠনসহ) পথ হারিয়েছে। আগে শিক্ষাকে পথে ফেরাতে হবে, তারপরে, তার আগে নয়, রাজনীতি ঠিক করা সম্ভব হবে। আমি বলি কাজটা কঠিনও নয়, অসম্ভবও নয়। কেননা, সাধারণ ছাত্ররা হয়তো মহৎ আদর্শের দৃষ্টান্ত ও মানসম্পন্ন সংস্কৃতিসমৃদ্ধ শিক্ষার অভাবে হতাশা, দিশাহীনতায় ভোগে, ভুল পথে পা বাড়ায়। কিন্তু সুযোগ দিলেই দেখা যায় যেকোনো ভালো কাজের ডাক পেলে, নেতৃত্বে আকৃষ্ট হলে তারা নির্দ্বিধায় সাড়া দেয়। এভাবেই সাম্প্রতিক কালে নির্দলীয় ছাত্র-তরুণদের তিনটি আন্দোলন আমরা দেখেছি, যা জাতি গ্রহণ করেছিল এবং অনেকে যুক্তও হয়েছেন। আমরা শাহবাগের গণজাগরণ, নিরাপদ সড়ক ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের কথা বলছি। বিপরীতে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল এ সময়ে কোথাও কোনো ন্যায্য দাবিতে ছাত্র-তরুণদের নিয়ে আন্দোলন করতে পারেনি। তারা জড়িয়েছে ভর্তি কোটা, সিট বরাদ্দ থেকে সরবরাহ ও উন্নয়নকাজের ট্রলারের বখরা আদায়ের অপকর্মে, তা থেকে ভুগেছে অন্তর্দলীয় কোন্দলে, যা সময়-সময় সশস্ত্র, প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে।
শিক্ষাকে দেশ, জাতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং প্রকৃত জ্ঞান ও সক্রিয় কর্মের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে জানার ও করার আনন্দময় বাতাবরণ তৈরির জন্য শিক্ষণ কর্মটিতে জ্ঞানার্জনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জন্য সৃজনে-মননে, অর্জনে-অবদানে তৃপ্তি লাভের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের জন্য খেলাধুলা, সাহিত্যপাঠ, ইতিহাস জানা, হাতে-কলমে পরীক্ষাসহ বিজ্ঞানচর্চা, নানা সৃজনশীল কাজ ও কলাচর্চা, যৌথভাবে আনন্দময় বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা জরুরি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, অন্তত দ্বাদশ বর্ষ পর্যন্ত তাদের সংগ্রহ ও সঞ্চয়নের কাল। পরীক্ষা তাদের এ কাজে বাধা দেয়। তার খেসারত আমরা দিচ্ছি। শিক্ষাকে যেমন ঠিক করতে হবে, তেমনি রাজনীতিকেও তো স্বখাতে ফিরিয়ে আনতে হবে। কেবল নিষিদ্ধের দাবি তুলে কাজ শেষ হবে না। দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতন্ত্রের পথে সুষম অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়ার কাজে বাধা অনেক। সেখানে চেতনায় ও নৈতিকতায় সমৃদ্ধ তরুণসমাজকে ভূমিকা রাখতেই হবে। তাদের সংগঠিত হওয়ার প্ল্যাটফর্ম তো লাগবে।
শেষ পর্যন্ত কিন্তু টার্গেট ছোট হয়েই আসছে। অপকর্মের সিংহভাগ ঘটছে বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ÿক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলে। আপাতত আওয়ামী লীগকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কীভাবে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নিয়ন্ত্রণে আনবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দলীয় তোষামোদি থেকে মুক্তি দেবে। মূল কাজ কিন্তু এই একটাই। ফলে শুদ্ধি অভিযানে দূষণমুক্ত হলেই হবে না, দূষণের আবহ ও পদ্ধতি চালু থাকলে কিশোর–তরুণেরা তো বিপথগামী হবে। দায় অস্বীকার নয়, স্বীকার করেই কাজে হাত দিতে হবে।
আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক