সেই মহামৃত্যুঞ্জয়
একজন সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী থেকে কী করে তিনি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্থপতি হলেন? মুজিব বা মুজিব ভাই থেকে কেমনভাবে হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু? এ তাঁর একাগ্রতার গুণে, স্থির লক্ষ্যের জোরে।
কৈশোরে যে-পরিবেশে লালিত হয়েছিলেন, সেখানে সম্প্রদায়ভেদ ও ছোঁয়াছুঁয়ির বাধানিষেধের একটা জায়গা ছিল। তাতে আহত বোধও করেছেন। মুসলিম লীগের রাজনীতি যে তাঁকে টেনেছিল, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তারই মধ্যে কলকাতায় ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ দাঙ্গার সময়ে, ইসলামিয়া কলেজের অর্থনীতির শিক্ষক ভবতোষ দত্তকে কয়েকজন ছাত্র মিলে মুসলমান এলাকা পার করে হিন্দু অঞ্চলের সীমান্তে পৌঁছে দিয়েছেন, আবার পরদিন সেখান থেকে নিয়ে এসেছেন। অনেক দিন পরে স্মৃতিকথায় ভবতোষ দত্ত লিখেছেন, ওই ছেলেদের দলপতি ছিল শেখ মুজিবুর রহমান। মুসলিম লীগ কর্মী যে-মানবিকতা জলাঞ্জলি দেননি, এ তারই প্রমাণ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় যত আনন্দ পেয়েছিলেন, বঙ্গ-বিভাগে ততটা বেদনা অনুভব করেছিলেন। পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারের কর্মধারায় দুঃখিত হয়েছিলেন ততোধিক। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের এক নেতা তিনি, গ্রেপ্তার হয়ে কারাবাস করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যত দিন না ছাত্রদের সমঝোতা হয়, চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
তারপর তো জেলযাত্রা হয়ে গেল নিয়মিত। তাঁকে পাকিস্তান-আন্দোলনের সৈনিক বলে জানত, এমন এক অবাঙালি কারারক্ষীর তাঁকে কারাগারে দেখে বিস্ময় লেগেছিল—এমন লোকও কারারুদ্ধ হয়!
কিন্তু কারাগারই তাঁর বাসস্থান, তাঁর শিক্ষায়তন হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষা নিয়েছিলেন অনেকটা সেখান থেকেই। পূর্ব বাংলায় নতুন বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মকর্তা নির্বাচিত হন কারাগারে থাকতেই। বিয়ে করেছেন, সন্তানও হয়েছে, কিন্তু রুজি-রোজগারের সন্ধান করেননি।রাজনীতিই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। সে-রাজনীতি ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি অতটা নয়, যতটা বাঙালির অধিকার আদায়ের রাজনীতি।
প্রাদেশিক মন্ত্রী হয়েছিলেন। একবার তো কয়েক দিন পরে আবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন, আরেকবার মন্ত্রিত্ব ছাড়েন নিজের রাজনৈতিক দলের কাজ করবেন বলে। সাংগঠনিক প্রতিভা ছিল, মানুষকে মনে রাখতে পারতেন। ছুটে বেড়াতে পারতেন প্রদেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। তাঁর রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দীর মতো কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে উৎসাহ ছিল না তাঁর, বরঞ্চ যাঁর সমালোচনা করতেন, যাঁর সঙ্গে পাতিয়েছিলেন নানা-নাতির সম্পর্ক, সেই এ কে ফজলুল হকের মতো প্রাদেশিক রাজনীতিই ছিল তাঁর সব।
আওয়ামী মুসলিম লীগ আওয়ামী লীগ হয়েছে, তার পেছনে কাজ করেছে তাঁর উৎসাহ। পূর্ব বাংলার নাম পূর্ব পাকিস্তান হয়েছে, তাতে তাঁর আপত্তি—বলেছেন, তাহলে তো বঙ্গোপসাগর ছাড়া বঙ্গের নাম কোথাও থাকল না। পাকিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্র হলো, এতেও তাঁর আপত্তি—বলেছেন, এ দেশ তো সব সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য।
সব সম্প্রদায়ের মানুষও তাঁকে নিজের বলে মনে করতে শুরু করে। প্রবীণ নেতা ছিলেন দেশে আরও—ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী। যখন তিনি ছয় দফা কর্মসূচি দিলেন বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে, তখন আর প্রথমোক্ত দুজন বেঁচে নেই। দেখা গেল, বাঙালিরা তাঁকেই মানছে নিজেদের নেতা হিসেবে, বাঙালির স্বার্থরক্ষক হিসেবে। যখন তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি, দেশের মানুষ নিজের জীবন তুচ্ছ করে, আইন অমান্য করে, দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছে; জেলের তালা খুলে তাঁকে মুক্ত করে এনেছে।
এ-ঋণ তিনিও অপরিশোধ্য বিবেচনা করেছিলেন। পাকিস্তানের একমাত্র সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি বারবার বলেছেন, দেশবাসীর কাছে যে-ওয়াদা করেছেন, তার খেলাফ করবেন না। করেনওনি। ক্ষমতাও হাতে আসেনি তাঁর। তিনি ডেকেছেন অসহযোগ আন্দোলন, পূর্ব বাংলার মানুষ এক হয়ে তাতে যোগ দিয়েছে। তিনি ডাক দিয়েছেন মুক্তিসংগ্রামের, তিনি ডাক দিয়েছেন স্বাধীনতা-সংগ্রামের। স্বল্পসংখ্যক দেশদ্রোহী ছাড়া সবাই সাড়া দিয়েছে তাতে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি অনুপস্থিত—কিন্তু তাঁরই নামে পরিচালিত হয়েছে সে-যুদ্ধ, তাঁরই নামে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশ।
বিজয়ীর বেশে তিনি ফিরে এসেছেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে। হাতে তুলে নিয়েছেন দেশের শাসনভার। ভুলচুক হয়নি, তা হয়তো নয়, কিন্তু দেশকে দিয়েছেন যথেষ্ট। বিপ্লবের নেতাদের নাকি গ্রাস করে নেয় বিপ্লব, নয়তো প্রতিবিপ্লব। এ ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি।
...সংশয়ে তাকে আমরা অস্বীকার করেছি,
ক্রোধে তাকে আমরা হনন করেছি,
প্রেমে এখন আমরা তাকে বরণ করব—
কেননা, মৃত্যুর দ্বারা সে আমাদের সকলের
জীবনের মধ্যে সঞ্জীবিত,
সেই মহামৃত্যুঞ্জয়।
—রবীন্দ্রনাথ, ‘শিশুতীর্থ’ (১৩৩৮)