হাটে নানা জাতের গরু, চাহিদা বেশি দুই জাতে
একটি জাতের শরীরজুড়ে লালের প্রভাব। লেজ, শিং এমনকি পায়ের খুরও লালচে। অন্যটি সম্পূর্ণ বিপরীত। গোটা শরীরের সঙ্গে পায়ের খুর, শিং, চোখের পাপড়ি, নাকের সামনের অংশ ও লেজের পশম—সবই সাদা। প্রথমটি চট্টগ্রামের স্থানীয় জাত লাল গরু বা রেড চিটাগাং ক্যাটেল (আরসিসি)। পরেরটি মীরকাদিমের ঐতিহ্যবাহী ‘ধবল গাই’। তবে বাংলাদেশে গরুর স্থানীয় এই দুটি জাতের মধ্যে মিলের জায়গাটি হচ্ছে দুই প্রজাতির মাংসই অত্যন্ত সুস্বাদু ও নরম। আর কোরবানিতে দেশের দুটি অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে এই দুই জাতের গরুর বিশেষ চাহিদা আছে।
প্রতিবছর কোরবানিতে চট্টগ্রামের বাসিন্দারা লাল গরু কোরবানি দেওয়াকে ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেন। একইভাবে পুরান ঢাকার অনেক বাসিন্দা এখনো মনে করেন, মীরকাদিমের গরু ছাড়া তাঁদের কোরবানি পূর্ণতা পায় না। তবে চাহিদা থাকলেও সরবরাহের ঘাটতি বাড়ছে দিনকে দিন। তাই বাজারে অন্যান্য জাতের গরুর চেয়ে এই দুটি জাতের গরুর দাম তুলনামূলক বেশি।
লাল গরু স্থানীয়ভাবে ‘চাঁটগাইয়া লাল গরু’ বা ‘সুন্দরী’ নামে পরিচিত। আর এই জাতের ষাঁড়কে বলা হয় ‘লাল বিরিষ’। চট্টগ্রামের সব অঞ্চলেই এই জাতের গরু কমবেশি দেখা যায়। তবে তুলনামূলক বেশি পাওয়া যায় সাতকানিয়া, আনোয়ারা, পটিয়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও রাউজান উপজেলায়। বাণিজ্যিক উৎপাদন খুবই কম। বেশির ভাগ গরু পালিত হয় গৃহস্থ পরিবারগুলোতে।
স্থানীয় কৃষক ও প্রাণিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবছর চট্টগ্রামে ছয় লাখের মতো গরু কোরবানি দেওয়া হয়। একসময় এর এক-তৃতীয়াংশই থাকত লাল গরু। স্বাভাবিক নিয়মে একটি গরু দুই-আড়াই বছরের ব্যবধানে প্রজনন করলেও লাল গরু প্রায় প্রতিবছরই বাচ্চা দেয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য গরুর চেয়ে বেশি হওয়ায় প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার সক্ষমতা বেশি। তবে অতিমাত্রায় সংকরায়ণের কারণে দেশীয় এই জাত এখন অনেকটা বিলুপ্তির পথে। হাইব্রিড জাতের গরুর তুলনায় মাংস ও দুধের পরিমাণ কম হওয়ায় এর প্রতি খামারিদের আগ্রহও দিন দিন কমেছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ কে ফজলুল হক ভুঁইয়া লাল গরু নিয়ে গবেষণা করছেন ২০ বছরের বেশি সময় ধরে। লাল গরুর বিশেষত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রথমত এই জাতের গরু দেখতে সুন্দর। গাভির দুধ অত্যধিক ঘন। আর ষাঁড়ের মাংস খুবই সুস্বাদু ও নরম। পৃথিবীতে এমন আর কোনো গরুর জাত পাওয়া যাবে না, একই সঙ্গে যার দুধ ও মাংস ভালো।
ফজলুল হক ভুঁইয়ার হিসাবে বর্তমানে গোটা চট্টগ্রাম এলাকায় বিশুদ্ধ লাল জাতের গরুর সংখ্যা আট হাজারের বেশি হবে না। এ ছাড়া ময়মনসিংহে সরকারি উদ্যোগে তিন শর মতো এবং সাভারে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএলআরআই) আড়াই শ লাল গরু লালন-পালন করা হচ্ছে। দেশের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতে লাল গরু সংরক্ষণে গবেষণা বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজি বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দেশি জাতের এই গরুর ওজন ৩ থেকে ৭ মণ পর্যন্ত হয়। প্রতিটি গরু থেকে ৩ থেকে ৫ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায়। মাংস ও দুধ উৎপাদনের পাশাপাশি চাষাবাদের জন্যও এই জাত বেশ উপযুক্ত।
চট্টগ্রামে কোরবানির বাজারে এবার মাঝারি আকারের একটা লাল গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে এক লাখ ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার সাদিক অ্যাগ্রো নামের একটা খামারে বিক্রির জন্য ১০টার মতো লাল গরু রাখা হয়েছে। খামারের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শরীফ বলেন, দুটি গরু এর মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। একটার দাম নিয়েছেন ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা, অন্যটি ১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
মীরকাদিমের গাভি মিলবে রহমতগঞ্জের হাটে
ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এবারও ঈদের দুই দিন আগে পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটি মাঠে পাওয়া যাবে ‘মীরকাদিমের গরু’ খ্যাত সাদা গাভি। হাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শনিবার দুপুর থেকেই ব্যাপারীরা নদীপথে এ গরু নিয়ে রহমতগঞ্জ হাটে পৌঁছাতে শুরু করবেন।
গত শতকের ত্রিশের দশকে চালু হওয়া রহমতগঞ্জ হাটটি গণি মিয়ার হাট নামেও পরিচিত। শুধু এই হাটেই মীরকাদিমের গাভি পাওয়া যায়। হাটের ইজারাদার শফি মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, একসময় এই হাটে কেবল মীরকাদিমের গাভিই পাওয়া যেত। বিশেষ ব্যবস্থায় লালন করা কয়েক হাজার গাভি বিক্রি হতে সময় লাগত না। গত বছর দুই শর মতো গাভি বিক্রি হয়েছে। এ বছর তা আরও কমবে।
স্থানীয় খামারিরা বলছেন, চালকল হারিয়ে যাওয়া, গোখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি, আবাদি জমি কমে যাওয়া এবং আগের মতো সাদা জাতের গাভি না পাওয়ায় বিলুপ্তির পথে মীরকাদিমের গাভি।
মীরকাদিমের কমলঘাট বন্দরের সঙ্গেই রয়েছে রিকাবি বাজার। এই বাজারে তেলের মিলের মালিক ছিলেন লুৎফর রহমান। বুধবার মীরকাদিমের গরু এত বিখ্যাত হওয়ার কাহিনি শোনালেন এই বৃদ্ধ। বললেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা এখানে আসতেন তেল, চাল, ডাল কিনতে। এখানকার সাদা গরুও তাঁদের নজর কাড়ে। সেই থেকে মীরকাদিমের গরু কেনার ঝোঁক শুরু হয়।
গরুর ব্যবসায়ী আলী আহম্মদ বলেন, কোরবানির জন্য তৈরি করতে গাভিগুলো প্রথমে আলাদা করে ফেলা হয়। এদের খাবারের তালিকায় থাকে খৈল, বুট, খেসারি, গম, মসুর ডালের ভুসি ও রাব (মিষ্টি গুড়)। সঙ্গে থাকে ভুট্টা গুঁড়া। কোনো ঘাস খাওয়ানো হয় না। তাই মীরকাদিমের গাভির মাংসে আঁশ কম থাকে। মাংস হয় নরম ও তেলতেলে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানা যায়, এবার কোরবানি ঈদ সামনে রেখে ২০টি মতো পরিবার মীরকাদিমের গাভি পালছেন। সব মিলিয়ে গাভির সংখ্যা ১২০ থেকে ২৩০টির বেশি হবে না।
ঢাকার রহমতগঞ্জের ব্যবসায়ী খাদেমুল ইসলামের বিশেষ পছন্দ মীরকাদিমের গাভি। তিনি বলেন, ‘হাটে মীরকাদিমের গাই ওঠে অল্প। মাঝারি সাইজের একটা গাই কিনতে এক লাখ টাকার বেশি পড়ে। বড় গরু দেড় লাখের নিচে পাওন যায় না। তয় মীরকাদিমের গাই কোরবানি দিতে না পারলে মনে হয়, কোরবানিই হয় নাই।’
বর্তমানে সাভারে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে ৩০টির মতো মীরকাদিমের গাভি পালা হচ্ছে। সংস্থাটির জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বাংলাদেশে অন্য সব জাতের গাভির দুধে ল্যাকটোজের পরিমাণ ৩ থেকে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়। অন্যদিকে মীরকাদিমের গাভির দুধে এটা ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ছাড়া বিশেষ প্রক্রিয়ায় পালন করার কারণে এর মাংসও সুস্বাদু হয়।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন প্রথম আলোর চট্টগ্রাম প্রতিনিধি সুজন ঘোষ ও মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি ফয়সাল হোসেন)