জোড়াতালির চক্রে সড়ক-মহাসড়ক

বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মহাস্থান এলাকায় সড়কে ইট ফেলে সংস্কার করা হচ্ছে। এতে সড়কে সৃষ্টি হয়েছে যানজট, দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। গতকাল দুপুরে।  ছবি: সোয়েল রানা
বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মহাস্থান এলাকায় সড়কে ইট ফেলে সংস্কার করা হচ্ছে। এতে সড়কে সৃষ্টি হয়েছে যানজট, দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। গতকাল দুপুরে। ছবি: সোয়েল রানা

বর্ষা শুরুর আগে সরকারি হিসাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়কের ৪ হাজার ২৪৭ কিলোমিটার খারাপ ছিল। এরপর ভারী বর্ষা ও বন্যায় তলিয়েছে অনেক সড়ক। চলছে জোড়াতালির মেরামতও। আসন্ন ঈদুল আজহায় যানবাহনের চাপ বেড়ে গেলে এই জোড়াতালির সড়ক ঘরমুখী মানুষকে কতটা স্বস্তি দিতে পারবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

এবারের বর্ষা ও বন্যায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও জামালপুরে অনেক আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক বানের পানিতে ভেসে গেছে। কিছু সড়ক এখনো পানির নিচে। পার্বত্য জেলা বান্দরবানে জাতীয় মহাসড়কেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর বলছে, বন্যায় ২৩ জুলাই পর্যন্ত ১৮টি জেলার ৪৫০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সড়ক পরিস্থিতি নিয়ে গত এক সপ্তাহে দুবার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি ঈদের এক সপ্তাহ আগেই ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত করে প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন।

প্রতিবছরই ঈদের আগে এই নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং মেরামতও হয়। তবে ভারী বৃষ্টিপাত না থাকলে এই মেরামত টিকে যায়। আর বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে তা ভেসে যায়।

সওজ সূত্র বলছে, নতুন নির্মাণ করা সড়কের বয়সসীমা গড়ে ২০ বছর। নতুন সড়কে পাঁচ বছর সেভাবে হাত দেওয়ারই কথা নয়। পুরোনো সড়ক পুনর্নির্মাণ হলে ১০ বছর টিকে থাকার কথা। আর বড় ধরনের মেরামতের পর সড়ক তিন থেকে পাঁচ বছর টিকে থাকে। কিন্তু এখন প্রায় সব সড়ক–মহাসড়কই মেরামত, দ্রুত ভাঙন এবং পুনরায় মেরামত—এই চক্রে চলছে।

সড়ক মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সওজের অধীনে থাকা সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, মেরামত ও প্রশস্তকরণে ৫৭ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ সময় ৫ হাজার ১৭৯ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত ও মজবুত করা হয়েছে। ১৪ হাজার ৯১৯ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন শ্রেণির মেরামত করা হয়েছে। এই হিসাবে গত এক দশকে ২০ হাজার ৯৮ কিলোমিটার পথে কোনো না কোনো ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বা মেরামত হয়েছে। অর্থাৎ ৯১ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক কোনো না কোনো খরচের আওতায় এসেছে।

এরই মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পর তা চালু হয়েছে দুই বছর আগে। এখনই এই মহাসড়কের বিভিন্ন স্থান উঁচু-নিচু হয়ে গেছে। আছে ফাটলও। এখন মেরামতের জন্য প্রায় ৮০০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের যশোর অংশ ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। একই অবস্থা ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়া পর্যন্ত অংশ।

>

বর্ষা–বন্যার মধ্যে পবিত্র ঈদুল আজহা
আগে থেকেই ২৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ সড়ক বেহাল
১৮ জেলার সড়ক বন্যায় নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত

সওজের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোটাদাগে তিন কারণে সড়ক আশানুরূপ টিকছে না। ১. অতিরিক্ত ভারবাহী যানবাহনের চলাচল। ২. নির্মাণ ও মেরামতকাজে দীর্ঘসূত্রতা। ৩. নিম্নমানের নির্মাণ ও মেরামত।

সওজের পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ উইংয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বন্যা আর বিস্তৃত না হলে ঈদের আগে সড়ক স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আশা করছেন, কোনো দুর্ভোগ হবে না। সড়ক নির্মাণ বা মেরামতের পর দ্রুত ভেঙে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সড়কের বড় শত্রু অতিরিক্ত ভারবাহী যানবাহন। এ ছাড়া যানবাহন চলাচলের যে হিসাব ধরে তাঁরা সড়ক নির্মাণ বা মেরামত করেন, তা দ্রুতই ছাড়িয়ে যায়। এ জন্য নির্মাণ ও মেরামতের পর সড়ক বেশি ভাঙে।

একই স্থানে বারবার দুর্ভোগ

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার দীর্ঘদিন ধরেই বেহাল। মহাসড়কের এই অংশে বাসের বিশেষ লেন (বিআরটি) নির্মাণের প্রকল্প চলমান। এর অধীনে সড়কের দুই পাশেই নালা নির্মাণ চলছে। ফলে মহাসড়কের এক-তৃতীয়াংশই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে আছে। বৃষ্টি হলেই টঙ্গী স্টেশন রোড, সাইনবোর্ড, চান্দনা চৌরাস্তা, বাসন ও ভোগড়া এলাকায় পানি জমে যাচ্ছে।

ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের যশোর অংশের ৩৮ কিলোমিটার এবং যশোর-বেনাপোল অংশের ৩৮ কিলোমিটার সড়ক মেরামত আর ভাঙন—এই চক্রে চলছে। এক প্রান্তের কাজ শেষ করে অন্য প্রান্তে যেতে যেতেই শুরু হয় ভাঙন। এ জন্য এক দশক ধরে সড়কটিতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। যশোর-খুলনা মহাসড়কের যশোরের চাঁচড়া থেকে অভয়নগর উপজেলার রাজঘাট পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার সড়ক মেরামতে ২০১৩ সালে ২২ কোটি টাকায় ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। সময়মতো কাজ হয়নি বলে সড়কটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ২০১৪ সালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঠিকাদারের নিয়োগ বাতিল ও কালো তালিকাভুক্ত করার নির্দেশ দেন। পরে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে মেরামতকাজ শেষ করা হয়। এখন সড়কের এই অংশে পুনরায় নির্মাণকাজ চলছে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকা।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটের ১২টি স্থানে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের সৈয়দপুর, আউশকান্দি, রুস্তমপুর, সদরঘাট, দেবপাড়া, পানিউমদা, বড়চর এবং বাহুবলের আবদানাড়াউল ও মিরপুর উল্লেখযোগ্য। সিলেটের লালাবাজার ও বাহাপুর এবং মৌলভীবাজারের শেরপুরের অবস্থাও ভালো নয়। এই স্থানগুলোও ভাঙন-মেরামতের চক্রে পড়েছে।

ঢাকা–রংপুর মহাসড়কের বগুড়া জেলার অধীনে আছে ৬৫ কিলোমিটার। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই সড়ক মেরামতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয় হয় মেরামতে। চলতি অর্থবছরে মেরামতে বরাদ্দ ১৮ কোটি টাকা। এরপরও সড়কের বেহাল দশা কাটেনি।

এই মহাসড়কের সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ অংশের প্রায় ১৮ কিলোমিটার মহাসড়ক আবারও বেহাল হয়ে পড়েছে। অথচ গত ঈদুল ফিতরের আগেই সড়কটি মেরামত করা হয়।

সওজের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব সময় সড়কের দুরবস্থার জন্যই যানজট বা দুর্ভোগ হয়, এমন নয়। কিছু কিছু স্থানে অব্যবস্থাপনার কারণে দুর্ভোগ হয়। কোথাও কোথাও সরু সেতুর কারণে যানজট হয়। যেমন, গত ঈদুল ফিতরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজট হয় বঙ্গবন্ধু সেতুর আগে-পরে। কারণ, ঢাকা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়ক এখন চার লেনের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেতু দুই লেনের। ফলে বিপুলসংখ্যক যানবাহন চওড়া সড়ক ধরে গিয়ে সরু সেতুতে আটকে যাচ্ছে। এরপর সিরাজগঞ্জে নলকা ও ধোপাকান্দি সেতু দুটি সরু। জরাজীর্ণ হওয়ায় যানবাহনের গতি কমে যাচ্ছে। এবার এলেঙ্গার আগে কিছু অংশ বেশ ভাঙাচোরা। ধোপাকান্দি ও নলকা সেতুও আগের মতোই নাজুক। ফলে যানবাহনের চাপ পড়লে এবারও যানজটের আশঙ্কা আছে।

সওজের সমীক্ষা

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়ক সওজের অধীনে। এগুলো জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক—এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। মোট সড়ক ২২ হাজার ৯১ কিলোমিটার। প্রতিবছর সওজ হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট মডিউল (এইচডিএম) পদ্ধতিতে সড়কের অবস্থা সমীক্ষা করে থাকে।

সর্বশেষ গত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৭ হাজার ৪৫২ কিলোমিটার সড়কের সমীক্ষা চালানো হয়েছে। প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় মে মাসে। সমীক্ষা প্রতিবেদনে ভালো, চলনসই, দুর্বল, খারাপ ও খুব খারাপ এই পাঁচ শ্রেণিতে সড়ক-মহাসড়ক ভাগ করা হয়। এইচডিএমের প্রতিবেদন বলছে, দেশের ২২ শতাংশ জাতীয় মহাসড়ক দুর্বল, খারাপ ও খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। অন্যদিকে আঞ্চলিক মহাসড়কের ২৩ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং ২৫ দশমিক ৬০ শতাংশ জেলা সড়ক খারাপ। তিন শ্রেণির সড়ক এক করে হিসাব করলে দেখা যায়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ২৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ খারাপ বা বেহাল।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সওজে বড় প্রকল্পে মনোযোগ বেশি বলে মেরামতে মনোযোগ একটু কম। আর মেরামতকাজটাও হয় অর্থবছরের শেষের দিকে, বর্ষা মৌসুমে। বর্ষা মৌসুমে মেরামত টিকবে না—এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, মেরামত করতে হবে শুষ্ক মৌসুমে, ভালোভাবে করতে হবে। আর নতুন সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে উপকরণ ব্যবহার এবং প্রযুক্তিগত কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন, সড়কের পিচ করার ক্ষেত্রে মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করা যায়। এই বিটুমিন ব্যবহার করা হলে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে উঁচু–নিচু হয়ে গেছে, তা হয়তো হতো না। 

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা)