কুতুবদিয়া ভাঙছে, শিল্প আসছে

কুতুবদিয়া দ্বীপের এক প্রান্তে ভাঙা বেড়িবাঁধের কোল ঘেঁষে শাহেরা বেগমের ছোট্ট কুঁড়েঘর। শাহেরার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর বিকেলে। তিনি বলেছিলেন, সাগর খেপে উঠলেও বেড়িবাঁধের কারণে তাঁর ঘরটি রক্ষা পাবে।

কিন্তু গত ৪ মে ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানার পর ফোনে দ্বীপবাসী একজন জেলে জানালেন, বেড়িবাঁধের ওই অংশ সাগরে ভেসে গেছে। শাহেরার কুঁড়েটি টিকে আছে, তবে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের প্রান্তে একেবারেই অরক্ষিত অবস্থায়।

গত চার যুগে কুতুবদিয়া দ্বীপের একটা বড় অংশ বঙ্গোপসাগরে ভেঙে চলে গেছে। একের পর এক বড় বড় ঝড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙেছে। অধিবাসীরা ধীরে ধীরে ছেড়ে যাচ্ছে পিতৃপুরুষের ভিটা, লবণখেত, ফসলের মাঠ আর মাছের ঘের। তাদের পেশা হচ্ছে দিনমজুরি।

বাস্তুহারা এসব মানুষ কিন্তু সঙ্গে করে তাদের ঠিকানাটি নিয়ে যাচ্ছে। যে এলাকায় তারা থিতু হচ্ছে, তার নাম দিচ্ছে ‘কুতুবদিয়াপাড়া’। প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, এসব মানুষ গিয়ে উঠছে কক্সবাজার জেলার সদর, মহেশখালী, রামু, চকরিয়া, ডুলাহাজারা ও পেকুয়া; খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার সদর, চট্টগ্রামের সদর ও আনোয়ারা উপজেলায়।

কুতুবদিয়া দ্বীপের যে বাতিঘর ১৮৪৬ সাল থেকে বঙ্গোপসাগরের জাহাজিদের আলো দেখাত, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে তা ভেঙে যায়। মেরামতে নজর ছিল না প্রশাসনের। বাতিঘরের জায়গায় এখন গড়ে উঠেছে বাতিঘরপাড়া নামের বসতি।

শিল্পকারখানা: প্রত্যাশা ও ঝুঁকি
সম্প্রতি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দ্বীপটির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সরকার কুতুবদিয়ায় জ্বালানি খাতের বড় অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) খাতের দুটি ভারতীয় কোম্পানি এখানে টার্মিনাল স্থাপনের আগ্রহ দেখিয়েছে। আসছে আরেকটি ইন্দোনেশীয় কোম্পানি।

আর সরকারের জ্বালানিবিষয়ক করপোরেশন পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশের কোম্পানি বেক্সিমকো বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে দ্বীপের ৭০০ একর জমি চেয়েছে। নিজস্ব ওয়েবসাইটে বেক্সিমকো বলেছে, দ্বীপটি হবে তাদের জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের কেন্দ্র। অন্যদিকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এই দ্বীপে অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে চাইছে।

পেট্রোবাংলার পদস্থ দুজন কর্মকর্তা বলেছেন, মহেশখালীর মতোই কুতুবদিয়াতেও জ্বালানি খাতের বিনিয়োগকারীরা বেশি যাচ্ছেন। মহেশখালীর চেয়ে কম, তবে কুতুবদিয়ার কাছেও বঙ্গোপসাগরের গভীরতা ৮ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত।

মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে সরকার সমুদ্রবন্দর করছে। সেখানে কয়লাসহ ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে বড় জাহাজ সহজে ভিড়তে পারবে। এলএনজি টার্মিনাল করতেও সুবিধা হবে। কুতুবদিয়া মাতারবাড়ী থেকে সমুদ্রপথে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে। ফলে কাঁচামাল-যন্ত্রপাতি বা এলএনজি দ্রুত আনা যাবে।

কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, বিদ্যুৎ নেই, বেশির ভাগ বেড়িবাঁধ ভাঙা। একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ের পর বহু মানুষ চলে গেছে, এখনো সুযোগ পেলেই যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০২০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ আসবে। শিল্পকারখানা হলে মানুষ কাজ পাবে, এলাকায় থাকবে। ভালো হবে।

>

দ্বীপ ভেঙে অর্ধেক
বেড়িবাঁধ ভেঙে আট কি.মি. হয়েছে
৬০ শতাংশ মানুষ উদ্বাস্তু
জ্বালানি ও ভারী শিল্পের উদ্যোগ আসছে

তবে বেশ কয়েকজন পরিবেশবিদ আশঙ্কা করছেন, শিল্পোদ্যোগগুলো ভাঙনপ্রবণ এই দ্বীপের নাজুক পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি করতে পারে। মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, সেন্ট মার্টিনসহ কক্সবাজার উপকূলের দ্বীপগুলো অনেক বিপন্ন জলচর বা উভচর প্রাণী ও পাখির আবাসকেন্দ্র। আছে চার-পাঁচ প্রজাতির ডলফিন আর বিপন্ন দুই প্রজাতির কাছিম।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, দ্বীপে শিল্প স্থাপন করতে গেলে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই অধিদপ্তরের অনুমোদন নিতে হবে। কোনোটির মারাত্মক দূষণের ঝুঁকি থাকলে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষার ব্যবস্থা রেখেই শিল্প করতে হবে।

জীবন ও ঝুঁকি
কুতুবদিয়া যেতে হয় কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মগনামা ঘাট থেকে ট্রলারে করে। ঘাট থেকে নেমে এক কিলোমিটার পথ পেরোলেই ছোট্ট একটি বাজার। সেখানে মাছ আর লবণের কেনাবেচা চলে। আরও তিন–চার কিলোমিটার পর বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের সারি সারি টাওয়ার চোখে পড়ে।

ঠিক তার নিচেই লবণখেত। প্রায় আট একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। নিরাপত্তাব্যবস্থাও নাজুক। বিদ্যুৎ অবশ্য পাওয়া যায় মাত্র এক মেগাওয়াট। সাকল্যে ৩৫০টি পরিবার দিনে সাত–আট ঘণ্টার জন্য ওই বিদ্যুৎ পায়। এ ছাড়া আছে একটি সৌর এবং একটি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ পায় ১২ শতাংশের মতো দ্বীপবাসী।

জোয়ার-ভাটার পানি থেকে কুতুবদিয়াকে রক্ষা করত এই বেড়িবাঁধ। গত শনিবার কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার আলীআকবরডেল তাবালেরচরে।  ছবি: জুয়েল শীল
জোয়ার-ভাটার পানি থেকে কুতুবদিয়াকে রক্ষা করত এই বেড়িবাঁধ। গত শনিবার কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার আলীআকবরডেল তাবালেরচরে। ছবি: জুয়েল শীল

এ বছর লবণ আর ধান—দুটিরই বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। প্রায় সাত হাজার একর জমিতে লবণ হয়েছে ৭০০ টনের বেশি। তবে দাম কম, তাই চাষিরা দুশ্চিন্তায় আছেন। আবার বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত লবণসহিষ্ণু ধান ভালো ফলন দিয়েছে। তবে সেই ধানের দামও কম।

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন গবেষক কুতুবদিয়া দ্বীপের ভৌগোলিক পরিবর্তন নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। গবেষণাটি বলছে, ১৯৭২ সালে দ্বীপের আয়তন ছিল ৭৭ বর্গকিলোমিটার। ২০১৩ সালে সেটা ৬৮ বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে।

এদিকে সরকারের দ্য সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) একটি সমীক্ষা বলছে, ১৮৪০ সালে কুতুবদিয়া দ্বীপের আয়তন ছিল প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু ক্রমান্বয়ে ভাঙতে ভাঙতে এ বছর তা ৪০ বর্গকিলোমিটারের কম হয়ে গেছে। উপজেলা প্রশাসনও একই রকম তথ্য দিচ্ছে।

উপকূলকেন্দ্রিক উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলছেন, ভাঙনের কারণে এবং বেড়িবাঁধের অভাবে দ্বীপটি ও দ্বীপের মানুষ অত্যন্ত ঝুঁকিতে আছে। তাঁর মতে, এ দ্বীপ রক্ষায় টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নিলে হবে না। দরকার একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা। আর দ্বীপবাসী ছিন্নমূল হলে সমস্যা বাড়বে।

উপজেলা প্রশাসনের হিসাবে, দ্বীপ ঘিরে ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধ ছিল। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এর অর্ধেক ভেঙে যায়। ক্রমে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, রোয়ানু, মহাসেন এবং সর্বশেষ ফণীর আঘাতে ভাঙতে ভাঙতে চলতি বছর বেড়িবাঁধ আট কিলোমিটারে নেমে এসেছে। ফলে এখন নিয়মিত জোয়ারেই দ্বীপের বড় অংশ তলিয়ে যায়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপক কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বেড়িবাঁধগুলো দ্রুত মেরামত করার জন্য অনুরোধ করেছেন। এখন সাগরের পানি অনেকটা উঁচুতে উঠে গেছে। বেড়িবাঁধগুলো মেরামতের সময় সেটা খেয়াল রাখতে হবে।

পানিসম্পদসচিব কবির বিন আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মন্ত্রণালয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার উপযোগী করেই দ্বীপের বেড়িবাঁধ মেরামত ও পুনর্নির্মাণ করতে যাচ্ছে। পাশাপাশি উপকূল রক্ষার জন্য শ্বাসমূলীয় বন সৃজন করতে হবে। সামগ্রিকভাবে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের দায়িত্ব কিন্তু বন ও পরিবেশ-সংক্রান্ত মন্ত্রণালয় আর অধিদপ্তরেরই থাকছে।

কুতুবদিয়া উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছরই স্বাভাবিক জোয়ার–ভাটায় কুতুবদিয়া দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙন হচ্ছে। দুই যুগ আগেও দ্বীপের জনসংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখ। এ বছর তা অর্ধেকের কম হয়ে গেছে। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে বেড়িবাঁধ ভাঙায় আরও পাঁচ হাজার মানুষ অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) সাবেক বাংলাদেশ পরিচালক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ দ্বীপের সোয়া লাখ বাসিন্দার পুনর্বাসনের বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাঁর মতে, এখানে কোনো কিছু করতে হলে স্থানীয় অধিবাসীদের আগে রক্ষা করতে হবে। ভাঙন ঠেকাতে হবে। নয়তো লবণ ও সামুদ্রিক মাছের বড় উৎস এই দ্বীপ, এখানকার অধিবাসী এবং প্রস্তাবিত বিনিয়োগ—সবকিছু বিপদে পড়বে।

একসময় এই দ্বীপ বনে আচ্ছাদিত ছিল। ড. ইশতিয়াক প্রথম আলোকে আরও বলেন, কুতুবদিয়াসহ উপকূলীয় দ্বীপগুলো ঝড়–জলোচ্ছ্বাসের প্রাথমিক আঘাত থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে রক্ষা করে। শিল্প এলাকা হিসেবে গড়তে গেলে এই সুরক্ষা অব্যাহত রাখার কথাও ভাবতে হবে।