'দাঁতের পোকা' ফেলুন!
>
- তারাগঞ্জের হাটে-মাঠে, পথেঘাটে স্বঘোষিত ডাক্তার, কবিরাজেরা নানা অপচিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন
- তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না
রংপুরের তারাগঞ্জ ও/এ উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে এক বৃদ্ধের ‘দাঁতের পোকা’ বের করছেন এক গ্রাম্য কবিরাজ। পাশাপাশি একই ওষুধে চোখের রোগ, আলসার, গ্যাস্ট্রিক ভালো হওয়ারও প্রচার চালাচ্ছিলেন। ছবি তুলতে গেলে প্রচার বন্ধ করেন তিনি। ৭ জুন বেলা তিনটায় ওই এলাকায় গিয়ে এ দৃশ্য দেখা গেছে।
জানতে চাইলে স্বঘোষিত ওই কবিরাজ তাঁর নাম আলমগীর হোসেন বলে জানান। কীভাবে একসঙ্গে এত রোগের চিকিৎসা দিচ্ছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভাই, পুরোনো বই পড়ে গাছগাছড়ার শিকড়-পাতা দিয়ে ওষুধ তৈরি করি। ২০ বছর থেকে মানুষের চিকিৎসা করে আসছি। আমি মানুষের উপকার করতে না পারলেও ক্ষতি করি না।’
চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘মানুষের দাঁতে পোকা বলে কিছু থাকে না। একধরনের ভণ্ড পোকা বের করার নামে মানুষকে ধোঁকা দেয়। সর্বরোগের ওষুধের নামে মানুষকে ক্ষতিকর অনেক কিছু খাওয়ায়। এর মাধ্যমে সরল মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকেরা।’
আলমগীর হোসেনের মতো আরও অনেকে তারাগঞ্জ উপজেলার হাটে-মাঠে, পথেঘাটে নানা অপচিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কোনো ব্যবস্থাও চোখে পড়ে না।
তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিন্নাত আলী বলেন, এ ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে ইউএনও আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি জানা ছিল না। কয়েক মাস আগে এখানে এসেছি। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
৭ জুন সকাল ১০টায় তারাগঞ্জ হাটের পূর্ব দিকের ফাঁকা জায়গায় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে মাইকে গান গাইছিল এক কিশোরী। শতাধিক লোক গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়েই শুনছিলেন সেই গান। কয়েকটি গান হওয়ার পর সেখানে হাজির হন ৪০ বছর বয়সের এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে কবিরাজ সম্রাট দাবি করে সমবেত লোকজনের উদ্দেশে বক্তৃতা শুরু করেন। ফাঁকে ফাঁকে সর্বরোগের ক্ষেত্রে কার্যকর ‘স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ’ বিক্রি করেন তিনি। শেষে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ব্যক্তি জানান, শুধু তারাগঞ্জেই নয়, রংপুরের বিভিন্ন পথে-হাটে তিনি নিয়মিত ওষুধ বিক্রি করেন। এ জন্য শিল্পী দল ও মাইক্রোবাস ভাড়া করেছেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা সবই তো বোঝেন। চুরি তো করি না, নেশাজাতীয়ও কিছু বেচি না। পেটের ধান্দায় এটা করি। এতে উপকার না হলেও ক্ষতি নাই।’
এলাকার সচেতন কয়েকজন বলেন, এসব হাতুড়ে চিকিৎসক-কবিরাজের বেশির ভাগই তেমন শিক্ষিত নন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে অনেকে নিজের নামের পাশে নানা রকম মিথ্যা উপাধি ও ডিগ্রি জুড়ে নিয়েছেন। শুধু হাট-বাজারেই নয়, বাসস্ট্যান্ড ও লোকের সমাগম হয়—এমন স্থানগুলো ওষুধ বিক্রির জন্য বেছে নেন তাঁরা। নানা কৌশলে প্রথমে তাঁরা লোকজন জড়ো করেন। এরপর আকর্ষণীয় উপস্থাপনায় পেটের ব্যথা, আমাশয়, জন্ডিস, হাঁপানি, যৌনরোগসহ সব ধরনের রোগ নিরাময়ের শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে ওষুধ বিক্রি করেন তাঁরা। এসব ওষুধ বিক্রেতা মানুষকে টানতে মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকদের চ্যালেঞ্জ জানাতেও দ্বিধা করেন না।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোস্তফা জামান চৌধুরী বলেন, হাটে-মাঠের এসব স্বঘোষিত চিকিৎসক-কবিরাজের ওষুধ অবশ্যই ক্ষতিকর। এগুলোতে রোগ না সেরে বরং বেড়ে যায়। চোখের চিকিৎসার জন্য ওই সব স্বঘোষিত ডাক্তার যে ওষুধ তৈরি করেন, তার প্রয়োগে স্বল্প সময়ের মধ্যেই মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। দাঁতের মাড়ি থেকে তাঁরা যে পোকা বের করেন, তা মানুষের তো নয়ই; কোনো পশুর দাঁতেও থাকা সম্ভব নয়। জনসাধারণের এ ব্যাপারে যেমন সচেতন হওয়া উচিত, তেমনি প্রশাসনের উচিত এসব হাতুড়ে চিকিৎসক-কবিরাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।