যানজটে যেন 'জান যায়'
বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ও নদীদূষণের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জবাসী নাকাল নিত্য যানজটে। রমজান মাস ও ঈদ সামনে রেখে এখন সেটা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
চাষাঢ়া এলাকার ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন বললেন, ‘প্রচণ্ড এই গরমে যানজটে অনেকটা “জান যায়” অবস্থা আমাদের।’ তিনি বলেন, চাষাঢ়া থেকে হেঁটে ২ নম্বর রেলগেট এলাকায় যেতে সময় লাগে বড়জোর ১০ মিনিট। কিন্তু রিকশা বা গাড়িতে যেতে কখনো কখনো ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। হেঁটে যাবেন, সে উপায়ও নেই। সব ফুটপাত হকারদের দখলে। হাঁটতে গেলেও গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগে।
চাষাঢ়া মোড়ের যানজট দিন গড়িয়ে রাত পর্যন্ত থাকে। নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু সড়ক। এ সড়কের চাষাঢ়া থেকে নিতাইগঞ্জ পর্যন্ত, ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী সড়কের ১ নম্বর রেলগেট এলাকায় সকাল ৯টার পর থেকে যানজটের শুরু। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা তীব্র আকার ধারণ করে। এর মধ্যে রিকশার সংখ্যা বেশি। একই চিত্র দেখা গেল চাষাঢ়া থেকে কিল্লারপুর সলিমুল্লাহ সড়ক, খানপুর থেকে ফলপট্টি পর্যন্ত নবাব সিরাজউদ্দৌলা সড়কসহ আশপাশের সড়কে। ছুটির দিন ছাড়া বাকি সব দিনেই একই ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, মাত্রাতিরিক্ত রিকশা ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও লেগুনার অবৈধ স্ট্যান্ড, বিপণিবিতানসহ বড় ভবনগুলোয় পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে রাখা, শহরের ভেতরে বাস ও ট্রাকস্ট্যান্ড, প্রধান সড়কে অনেক রেলক্রসিং, বিকল্প সড়ক না থাকা ও ফুটপাতের অবৈধ দখল যানজটের অন্যতম কারণ।
তবে নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার সালেহ উদ্দিন আহমেদের মতে, বেশ কয়েকটি রেলক্রসিং ও বিপুলসংখ্যক রিকশা এখানে যানজটের বড় কারণ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশ কাজ করছে। মাহে রমজানের যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের জনবল বাড়ানো হয়েছে। ঈদের সাত দিন আগে আরও বাড়ানো হবে।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, মূল শহরে ১০ হাজার, সিদ্ধিরগঞ্জে ৫ হাজার ও বন্দর উপজেলায় ৩ হাজার রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর দুই থেকে তিন গুণ বেশি রিকশা সড়কে চলছে। অবৈধ রিকশার বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশন মাঝেমধ্যে অভিযান চালায়। তবে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছে না প্রভাবশালী একটি মহলের কারণে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, বিআরটিএ কিংবা সিটি করপোরেশনের কোনো লাইসেন্স বা অনুমোদন ছাড়াই ব্যাটারিচালিত প্রায় দুই হাজার ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। এসব অবৈধ যান থেকে অটোরিকশা মালিক ও শ্রমিক সমিতির নামে প্রতিদিন টোকেন দিয়ে ৩০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। এর আগে প্রতিটি ইজিবাইক নামানোর সময় এককালীন ৫ হাজার টাকা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা নামানোর সময় ২ হাজার টাকা দিতে হয়। এর নেপথ্যে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মহলটি জড়িত বলে অভিযোগ আছে।
ইজিবাইকের মতো দিনের বেলায় ট্রাক চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশা, লেগুনার অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদ ও ফুটপাত থেকে হকার সরাতে পারছে না সিটি করপোরেশন। সম্প্রতি এ ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়ে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একাধিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানান, অবৈধ যানবাহনের চেয়ে প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি চাঁদা ওঠে ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে। এই চাঁদাবাজিও নিয়ন্ত্রণ করে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মহলটি। এ কারণে ইতিপূর্বে হকার উচ্ছেদের চেষ্টা করতে গিয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র হামলার শিকার হন।
সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধান সড়কের ফুটপাত সম্পূর্ণ হকারদের দখলে। চেষ্টা করেও সরানো যায়নি, বাধা এসেছে। হকারদের জন্য অন্য আটটি সড়কে বিকল্প জায়গা করে দিয়েছি। বিকল্প জায়গার পাশাপাশি তারা এখানেও রয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত হলো, দিনে নগরীতে ট্রাক ঢুকবে না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে না। এরপর এক বছর ট্রাক ছিল না। টার্মিনাল করে দিয়েছি। তারপরও এখন আবার ট্রাক রাস্তায় ফিরে এসেছে।’ তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন একা যানজট নিরসন করতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে। সবার সহযোগিতা লাগবে।
আন্তজেলা বাসস্ট্যান্ড শহরের একেবারে ভেতরে। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের সব গাড়ি নগরীর ভেতর দিয়ে চলাচল করে। আবার বাসস্ট্যান্ডের ভেতরে জায়গা দখল করে অবৈধভাবে ওয়ার্কশপ করা হয়েছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক বাস রাস্তার ওপর রাখা হয়। অনেকের মতে, এই বাসস্ট্যান্ড নগরীর বাইরে সরিয়ে নিলে যানজট কিছুটা কমবে। তবে এর বিপক্ষেও মত আছে। সেটা হলো, নারায়ণগঞ্জ হয়ে প্রতিদিন আশপাশের জেলার বিপুল মানুষ অন্যান্য জেলায় যাতায়াত করে। এখানকার রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ও লঞ্চঘাট এক জায়গা হওয়ায় মানুষ দূরপাল্লার এক গন্তব্য থেকে আরেক গন্তব্যে সহজে যেতে পারে।
এ বিষয়ে এখানকার ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, বাসস্ট্যান্ড নগরীর বাইরে সরিয়ে নিয়ে টাউন সার্ভিস বা গণপরিবহন চালু করলে মানুষের অসুবিধা হবে না। ২০ লাখ লোকের এই নগরীর ভেতরে চলাচলের জন্য কোনো গণপরিবহন না থাকায় মানুষ রিকশা বা অন্য ছোট বাহনের ওপর নির্ভরশীল হয় পড়েছে।
বাসস্ট্যান্ডের মতো রেলস্টেশনও নগরীর ভেতর। বঙ্গবন্ধু সড়কেই আছে তিনটি রেলগেট। প্রতিদিন ৩২ বার ট্রেন আসা-যাওয়া করে। প্রতিবার প্রতিটি গেট বন্ধ রাখতে হয় কমপক্ষে ৩ মিনিট। তিনটি গেট মিলে প্রতিবার রাস্তা বন্ধ থাকে ৯ মিনিট। এভাবে দিনে মোট সাড়ে চার ঘণ্টার বেশি বন্ধ থাকে নগরীর মূল সড়ক। এর জেরে যানজট দীর্ঘতর হয়।
ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১১ সালে সমন্বয় কমিটির সভায় ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল, সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টায় অফিস ছুটি পর্যন্ত ট্রেন শহরের ভেতরের স্টেশনের পরিবর্তে যেন চাষাঢ়া স্টেশন থেকে চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। সে প্রস্তাব আর এগোয়নি।
নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, নাগরিক আন্দোলন, অনুষ্ঠান-পার্বণে শোভাযাত্রা, বিশিষ্ট কেউ মারা গেলে শবযাত্রা সবই হয় বঙ্গবন্ধু সড়কে। এই সড়ক বন্ধ হলে পুরো নগরী অচল হয়ে যায়। তাই বঙ্গবন্ধু সড়কের বিকল্প হিসেবে রেললাইনের পাশ দিয়ে একটি বিকল্প সড়কের প্রস্তাবও উঠেছিল অনেক আগে। সে পরিকল্পনাও আর এগোয়নি। মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী জানালেন, রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিল তারা পাশের জায়গায় রেলের আরেকটা লাইন বসাবে।
১৬ মে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হারুনুর রশিদ আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘যানজট নিয়ন্ত্রণে সড়ক বা মহাসড়কে যা যা করা দরকার, আমরা করছি। ঈদ পর্যন্ত পুলিশ সড়কে থেকে তা করবে।’
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের আহ্বায়ক ও নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের যানজট সমস্যার মূলেও দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি। ফুটপাতে হকার বসানো, দিনে ট্রাক ঢোকানো, অবৈধ লেগুনা, অটোরিকশা ও গাড়িস্ট্যান্ড এবং এসব থেকে মাসে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায়—এসবই নিয়ন্ত্রণ করে আসছে সরকারি দলের সুবিধাভোগী একটা অংশ। যার কারণে বঙ্গবন্ধু সড়ক হকারমুক্ত করা নিয়ে মেয়র ও চাঁদাবাজ রাজনীতিকদের মধ্যে রক্তারক্তির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সমাধান আসেনি।’ তিনি বলেন, এসব রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা সরকার ও প্রশাসন থেকে সমর্থন পায়। বর্তমান পুলিশ সুপার আসার পর যানজট, মাদক, জুয়াড়ি, ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়েছেন। এতে আপাতকিছু অগ্রগতি মনে হলেও স্থায়ী সমাধান আসবে না। এখানে সবার সমন্বিত ও শক্ত কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। (শেষ)