চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভার মেয়র রফিকুল আলম ওরফে জজ প্রায় চার মাস ধরে অফিসে আসছেন না। এ কারণে পৌরসভার দাপ্তরিক ও উন্নয়নকাজে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন পৌরবাসী। তবে মেয়রের দাবি, নিরাপত্তার অভাবে তিনি এলাকায় এবং অফিসে যেতে পারছেন না।
ছেংগারচর পৌরসভা কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১১ এপ্রিল মেয়রের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ও কাউন্সিলরদের লিখিত অনাস্থার তদন্ত হয়। চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা হাকিম (এডিএম) আবদুল্লাহ আল জামান মতলব উত্তর উপজেলা পরিষদে ওই অভিযোগের তদন্ত করেন।
ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, জোর করে অন্যের জায়গা দখল, কাউন্সিলরদের মধ্যে উন্নয়নের বরাদ্দ বণ্টনে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ এনে গত মাসে পৌরসভার অধিকাংশ কাউন্সিলর স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ে মেয়রের বিরুদ্ধে লিখিত অনাস্থা ও অভিযোগ দেন।
সূত্রটি আরও জানায়, মেয়র রফিকুল সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত লোক হিসেবে এলাকায় পরিচিত। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-২ আসনে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার পরিবর্তে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. নুরুল আমিন ওরফে রুহুল। মায়া দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় এলাকায় কোণঠাসা হয়ে পড়েন মেয়র রফিকুল। গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে আজ পর্যন্ত তাঁকে এলাকায় দেখা যায়নি। মেয়রের দপ্তরে অফিসও করেননি।
ছেংগারচর পৌরসভার কাউন্সিলর মান্নান বেপারীসহ আরও দুজন কাউন্সিলর অভিযোগ করেন, মেয়র রফিকুল পৌরসভার অধিকাংশ কাউন্সিলরকে তেমন পাত্তা দেন না। স্বেচ্ছাচারিতা করেন। পৌরসভার সব উন্নয়নকাজ তিনি তাঁর পছন্দের লোক দিয়ে করিয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার, জোর করে অন্যের জায়গা দখল, দুর্ব্যবহার ও ক্ষমতার দাপট দেখানোসহ নানা অভিযোগে পৌরসভার অধিকাংশ কাউন্সিলর তাঁর বিরুদ্ধে গত মার্চ মাসে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ ও অনাস্থা দেন। ১১ এপ্রিল ওই অভিযোগ ও অনাস্থার তদন্ত হয়।
ছেংগারচর পৌরসভার শিকিরচর গ্রামের শাহ আলম অভিযোগ করেন, গত নভেম্বরে মেয়র রফিকুল ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ছেংগারচর বাজারে তাঁর একটি দোকান দখল করেন। এ বিষয়ে ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন তিনি।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা হাকিম (এডিএম) আবদুল্লাহ আল জামান প্রথম আলোকে বলেন, মেয়র রফিকুল আলমের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা ও অভিযোগের তদন্তকাজ শেষ করে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আনা বেশ কিছু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে সব অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। জেলা প্রশাসক এ-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছেংগারচর পৌরসভার একজন কাউন্সিলর ও দুজন কর্মচারী বলেন, মেয়র রফিকুল দীর্ঘদিন ধরে কর্মস্থলে না থাকায় পৌরসভার দাপ্তরিক, উন্নয়নসহ বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী কাজে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। একজন কাউন্সিলর (প্যানেল মেয়র) ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তাঁর পক্ষে উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণী কাজ করা সম্ভব না। ভারপ্রাপ্ত মেয়র দিয়ে মূল মেয়রের কাজ হয় না। মেয়র না থাকায় সম্প্রতি পৌরসভার উন্নয়ন খাতে প্রায় ৪ কোটি টাকার বরাদ্দ মন্ত্রণালয়ে ফিরে গেছে বলেও জানান তাঁরা।
ওই পৌরসভার ছেংগারচর, ঠাকুরচর ও কেশাইরকান্দি এলাকার ছয় বাসিন্দা অভিযোগ করেন, মেয়র না থাকায় তাঁদের অনেক ভোগান্তি হচ্ছে। জন্ম, ওয়ারিশ ও মৃত্যুসনদ, ট্রেড লাইসেন্সসহ নানা কাজে গিয়ে সেখানে হয়রানির শিকার হতে হয়। এক দিনের কাজ ১৫ দিনেও হয় না।
জানতে চাইলে ছেংগারচর পৌরসভার মেয়র রফিকুল আলম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন ও অসত্য। তিনি মূলত রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার। কারও নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, প্রতিপক্ষ নানাভাবে তাঁকে হুমকি দিচ্ছে। গত সংসদ নির্বাচনের পর থেকে নিরাপত্তার অভাবে তিনি এলাকায় যেতে পারছেন না। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ও চাঁদপুরের পুলিশ সুপারের কাছেও আবেদন করেছেন বলে জানান তিনি। এ ছাড়া মতলব উত্তর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে টেলিফোনেও নিরাপত্তার অভাবের কথা জানানো হয়েছে। এরপরও তাঁর নিরাপত্তায় প্রশাসন বা পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেন মেয়র। তাঁর দাবি, মেয়র হওয়ার পর এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। পৌরবাসীকে প্রত্যাশিত সেবা ও সুবিধা দিয়েছেন। কর্মস্থলে যেতে না পারায় এসব উন্নয়নকাজ বন্ধ হয়ে আছে।
মতলব উত্তর থানার ওসি মো. মিজানুর রহমান বলেন, মেয়র রফিকুল নিরাপত্তা চেয়ে থানায় কোনো আবেদন করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও ফৌজদারি মামলা রয়েছে। এসব কারণে তিনি কর্মস্থল ও এলাকায় আসেন না।