দুপুরের খাবার শুকনা চিড়া আর গুড়
ভোর চারটা। গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কারাগারের বন্দী কমলা বেগমের (ছদ্মনাম) দিন শুরু। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেন। ডাল-ভাত খেয়ে নেন। সকাল ছয়টায় প্রিজন ভ্যানে উঠে বসেন। সকাল আটটায় প্রিজন ভ্যান আদালতে পৌঁছায়। কমলাসহ অন্য কারাবন্দীদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার আদালতের হাজতখানায়। এরপর দুপুর ১২টায় কমলাকে আদালতের এজলাসে তোলা হয়। শুনানি শেষ হতে হতে দেড়টা। কমলাকে আবার নেওয়া হয় হাজতখানায়।
দুপুরে খাবারের জন্য কাশিমপুর কারাগার থেকে চিড়া আর গুড় দেওয়া হয়েছিল, কমলা তা নিয়ে আসেননি। ফলে পানি ছাড়া পেটে পড়েনি কোনো দানা । বিকেল চারটায় কমলা আবার গাঢ় নীল রঙের প্রিজন ভ্যানে বসেন। হুইসেল বাজিয়ে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের (সিএমএম) সামনে দিয়ে গাড়ি চলতে থাকে। ভ্যাপসা গরম আর যানজট ঠেলে কমলাদের প্রিজন ভ্যান কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছায় রাত আটটায়। এরপর হাতমুখ ধুয়ে কমলা রাতের খাবার গোগ্রামে গিলতে থাকেন। গত ২১ মার্চ এই ছিল কমলার রোজনামচা।
ঢাকার আদালতে হাজিরার দিন শুধু কমলা নন, কারাগারের অন্য নারীদের জীবনের গল্পটা এমনই থাকে। হাজিরার দিন বেশির ভাগ নারী কয়েদি দুপুরে না খেয়েই কাটিয়ে দেন। বিভিন্ন ধকলের পর দুপুরে শুকনা চিড়া আর গুড় মুখে নিতে ইচ্ছে করে না।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান খান বলছিলেন, ‘ভোর চারটা-পাঁচটায় ডাল-ভাত খেয়ে আবার রাতে ফিরে ভাত খাওয়া, এটা ভাবা যায় না।’
কাশিমপুর কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক শাহজাহান আহম্মদও জানালেন, নারীদের অনেকেই চিড়া ও গুড় নিতে চান না। ফলে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থেকে প্রায়ই নারীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন ধরে নারী কয়েদিদের আনা-নেওয়া করা এক নারী কনস্টেবলও জানালেন একই কথা। ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানার কর্মকর্তা মইনুল ইসলামও বললেন, নারীদের বেশির ভাগই যে খাবার নিয়ে আসেন না, তিনিও তা শুনেছেন।
ঢাকা থেকে গাজীপুরের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। দুটি প্রিজন ভ্যানে নারীদের কাশিমপুর থেকে ঢাকা, আবার কাশিমপুরে আনা-নেওয়া করা হয়। কাশিমপুর মহিলা কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক শাহজাহান আহমেদ জানান, বর্তমানে ৯৫৭ জন নারী বন্দী আছেন কারাগারটিতে। তাঁদের মধ্যে ৬৯ নারীর সঙ্গে শিশু আছে।
কমলা তবু একলা ছিলেন, কিন্তু পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা রাহেলা (ছদ্মনাম) বা শিশুসন্তানকে নিয়ে আদালতে আসা রাফিয়াদের অবস্থা আরও খারাপ হয়।
আদালতের একজন নারী পুলিশ কনস্টেবল নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানালেন, প্রচণ্ড রোদের সময় প্রিজন ভ্যান গরম হয়ে যায়। এর সঙ্গে ঝাঁকুনিতে ভ্যানের ভেতর গড়াগড়ি খান নারীরা। না খেয়ে থাকা বা যাঁরা চিড়া-গুড় আনেন, সেই অর্থে তাঁরাও তা খেতে পারেন না। আর অন্তঃসত্ত্বা বা যে নারীর সঙ্গে শিশু থাকে, ফেরার পথে তাঁরা বেশি কাহিল হয়ে পড়েন।
কাশিমপুর মহিলা কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক শাহজাহান আহমেদ নারী কয়েদিরা যাতে চিড়া-গুড় সঙ্গে নেন, তা নিশ্চিত করার আশ্বাস দিলেন।
তবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালের মতে, দুপুরের খাবার থেকে চিড়া-গুড় অবশ্যই বাদ দিতে হবে।
খাবার এবং প্রিজন ভ্যানের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সুলতানা কামাল বলেন, নারী কয়েদিদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে, তা অমানবিক বললেও কম বলা হবে। সভ্য সমাজে এমন আচরণ করা যায় না। মনে রাখতে হবে, অপরাধীদের আদালত যে শাস্তি দিয়েছেন তা তাঁদের প্রাপ্য। এর বাইরে তাঁদের সঙ্গে কোনো অন্যায় আচরণ বা অসুবিধা করা যাবে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ আগে রুটি আর গুড় দেওয়া হতো। এখন তা পরিবর্তন করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটা ফাইল এসেছিল আমার কাছে। আর দীর্ঘ রাস্তায় প্রিজন ভ্যানে কয়েদিদের অসুবিধা হয়, তা অস্বীকার করার কিছু নেই। কয়েদিদের সংখ্যা বাড়ছে। নতুন প্রিজন ভ্যান কেনা হচ্ছে। তখন সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে।’