পরিকল্পনার ভুলে 'লাইনচ্যুত' রেল

>

* ব্যক্তি-গোষ্ঠীর ইচ্ছাপূরণ নয়
* যাত্রী সেবাকে অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প নিতে হবে
* সময়মতো শেষ করতে হবে

রেলের প্রায় সব রুটে টিকিটের জন্য যাত্রীদের হাহাকার লেগেই থাকে। তার মানে রেলের সেবা নেওয়ার পর্যাপ্ত লোক আছে। তা হলে আয় বাড়ারও সুযোগ আছে। কিন্তু গত এক দশকে রেল খাতে বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও এই সাধারণ সূত্র মেনে তা করা হয়নি। ফলে খরচ যত হয়েছে, তার সিকি ভাগও আয় হয়নি।

তাহলে এত টাকা কোথায় খরচ হলো? খরচের ধরন পর্যালোচনা করে রেলের সূত্রগুলো বলছে, সেবা ও যাত্রী বাড়ানোর মতো প্রকল্পগুলো আগে নেওয়া হয়নি। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে। ব্যক্তি-গোষ্ঠীর ইচ্ছাপূরণ ও দুর্নীতির প্রভাবের কারণে এমনটি হয়েছে।

উত্তরণের উপায় কী? রেলের জন্য ৩০ বছর মেয়াদি যে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা আছে, তাকে যাত্রীর চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাতে খরচ আরও বাড়বে। এই খরচ তুলতে হবে আয় বাড়িয়ে। আয় বাড়ানোর চাবিকাঠি চাহিদামতো সেবা দেওয়া।

আন্তনগর ট্রেনে যাত্রার ১০ দিন আগে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়। কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রথম দিনই বেশির ভাগ টিকিট বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত কর্মকর্তাদের কক্ষে ঘুরে দেখা গেছে, তাঁদের মুঠোফোনে ক্ষণে ক্ষণে টিকিটের আবদার আসছে।

গত সাত বছরে রেলের ভাড়া দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। তবু টিকিটের চাহিদা অনেক। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, স্টেশনে টিকিট নিয়ে হাহাকার দেখা যায়। অর্থাৎ রেলযাত্রার চাহিদা আছে, কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ তা ধরতে পারছে না।

রেল পরিচালনার উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, আয় বাড়াতে হলে মালামাল পরিবহন বাড়াতে হবে। নতুন নতুন পথে ট্রেন চালু করতে হবে। দরকার ইঞ্জিন ও কোচ। এগুলোর বদলে ডেমু ট্রেন কেনা অগ্রাধিকার পেয়েছে। স্টেশন ও সেতু নির্মাণ, লাইন মেরামতে দিনের পর দিন টাকা ঢালা হয়েছে।

অতীতের বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে ভবিষ্যতে দুর্নীতি ঠেকানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, রেলে কিছুই ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসে রেলকে গুরুত্ব দিয়েছেন, বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন। এর পুরো সুফল পেতে হয়তো পাঁচ বছর লাগবে। সবার আগে সময় মানা, পরিচ্ছন্নতা, ছাদে যাত্রী না ওঠানো বা টিকিট বিক্রিতে শৃঙ্খলা আনার মতো বিনা বিনিয়োগের সেবাগুলো বাড়াতে হবে।

আয়-ব্যয়ের হিসাব

গত ১০ বছরে উন্নয়ন প্রকল্প আর রেল পরিচালনা মিলিয়ে খরচ হয়েছে সাড়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আয় হয়েছে এর ছয় ভাগের এক ভাগ, সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার মতো।

২০৪৫ সাল পর্যন্ত রেল উন্নয়নের মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা খরচ করার কথা আছে। সেই অনুপাতে আয় বাড়াতে না পারলে লোকসানের পাল্লা ভারী হবে, ঋণের বোঝা বাড়বে রেলে। এখানেই দরকার যথাযথ পরিকল্পনা। যথাযথ উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে সময়মতো কাজ শেষ করতে হবে। অপচয়-দুর্নীতির কালো বিড়ালকে বাগে আনতে হবে।

উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ আসে সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দ থেকে, যার বেশির ভাগই বিদেশি ঋণ। আর বেতন-ভাতা, জ্বালানিসহ নিয়মিত পরিচালনার খরচ মেটে রাজস্ব বাজেট থেকে। আয় হয় মালামাল পরিবহন, টিকিট বিক্রি আর জমির ইজারা থেকে।

বার্ষিক লাভ-লোকসানের হিসাবে অবশ্য উন্নয়ন ব্যয় বিবেচ্য নয়। সে হিসাবটা হয় আয়ের অনুপাতে পরিচালনা ব্যয়ের নিরিখে। পরিচালনা ব্যয় বার্ষিক আয়ের যত শতাংশ দাঁড়ায়, সেটাকে বলে অপারেটিং রেশিও। এটা ১০০ শতাংশের যত নিচে থাকে, লাভ তত বেশি। ১০০ শতাংশ ছাড়ালে লোকসানের শুরু। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেলওয়ের অপারেটিং রেশিও ছিল ২১৭ শতাংশ। অন্যভাবে বললে পরিচালনার খরচ ছিল আয়ের দ্বিগুণের বেশি। টাকার অঙ্কে লোকসান দেড় হাজার কোটির বেশি।

বাংলাদেশে কেবল ১৯৬৯-৭০ সালেই ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি ছিল রেলে। অপারেটিং রেশিও ছিল ৮৩ শতাংশ। ভারতসহ বিশ্বের যেসব দেশে রেল জনপ্রিয়, সেসব দেশে তা কমবেশি লাভজনক। রেল খাতের মহাপরিকল্পনা বলছে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়েও বেশি অনুপাতে লোকসান গোনে।

সেবা বাড়ছে না

রেলওয়ের হিসাবে, স্বাধীনতার পর থেকে রেলপথ, ইঞ্জিন, কোচ, মালবাহী ওয়াগন—সবই ক্রমে কমেছে। গত এক দশকে এগুলো কমবেশি তৈরি বা কেনা হয়েছে। কিন্তু যোগ-বিয়োগ করে ওই সময়ের তুলনায় মোট সম্পদ তেমন বাড়েনি, বরং কমেছে।

যেমন ৩৩০ কিলোমিটার রেলপথ তৈরি হয়েছে, কিন্তু আদতে বেড়েছে মাত্র ৭১ কিলোমিটার। রেলপথের কোথাও কোথাও একাধিক লাইন রয়েছে। সব লাইনের যোগফল মিলিয়ে রেললাইনের হিসাব। রেললাইন কিন্তু ১৫৬ কিলোমিটার কমে গেছে।

একইভাবে ৪৬টি ইঞ্জিন কেনা হয়েছে, কিন্তু কার্যত কমেছে ২১৪টি। আমদানি করা হয়েছে ২৭০টি কোচ, প্রায় ৫৫০টি মালবাহী ওয়াগন ও ব্রেক ভ্যান। কিন্তু ওয়াগন অর্ধেকে নেমে সাড়ে ৮ হাজার হয়েছে। কোচ কমেছে ১৬টি।

গত জুনে ৭০টি মিটারগেজ ডিজেল ইঞ্জিন কেনার একটি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখনো একটি ইঞ্জিনও আসেনি। প্রকল্পের সময় বাড়ানো হয়েছে। ২০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন আর ১৫০টি যাত্রীবাহী কোচ কেনার আরেক প্রকল্প দুই বছরেও এগোয়নি।

এখনো পুরো দক্ষিণাঞ্চলসহ ২০টি জেলা রেল যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত। যে ৪৪ জেলায় রেল যোগাযোগ আছে, তার মধ্যে চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, লালমনিরহাট, জামালপুর ও কুমিল্লায় রেলপথ অনেক বেশি। স্টেশনও বেশি।

গত ১০ বছরে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে রেললাইন, সেতু আর স্টেশন নির্মাণ ও মেরামতের কাজে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু কাজ শেষ হয়নি, রেলের গতি বরং কমেছে। যেমন সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেন ২০০০ সালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেত পাঁচ ঘণ্টায়। নির্ধারিত সময় ১০ মিনিট বেড়েছে। আরও বাড়তে পারে।

রেলওয়ের হিসাবে ২০১৩ সালে ১৮০ কোটি টাকায় ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সংস্কার করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এতে এই পথে ঘণ্টায় ৬৫ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে। কিন্তু কখনোই তা হয়নি। একই দশা লাকসাম থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পুনর্বাসিত রেলপথে। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ট্রেনযাত্রা আরও ধীর।

বাংলাদেশে এখন তিন ধরনের রেললাইন আছে। মিটারগেজ ও ব্রডগেজ এবং দুটোই চলার উপযোগী মিশ্র গেজ। পূর্বাঞ্চলে প্রায় পুরোটাই মিটারগেজ, পশ্চিমাঞ্চলে ব্রডগেজ বেশি। সমন্বয় করা কঠিন হয়। পাশের দেশ ভারতও এখন একক ব্যবস্থায় গেছে।

৩০ বছরের মহাপরিকল্পনা

গত বছরের জানুয়ারি মাসে ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা অনুমোদিত হয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০৪৫ সাল পর্যন্ত সময়কে ছয়টি ভাগে ভাগ করে মোট ২৩০টি প্রকল্প পরিকল্পিত হয়েছে। প্রাক্কলিত ব্যয় সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা।

এর আগে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা নিয়েছিল। প্রকল্প বাস্তবায়নে ঢিলেমির কারণে সেটা বাদ গেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিপিসিএস ট্রান্সকম লিমিটেড নতুন মহাপরিকল্পনাটি তৈরি করেছে।

এই মহাপরিকল্পনা বলছে, ঠিকভাবে কাজ এগোলে বছরে ৫ শতাংশ হারে যাত্রী পরিবহন বাড়বে। মালামাল পরিবহনও বাড়বে। ২০২০ সালের মধ্যে অনেক নতুন ইঞ্জিন ও কোচ কেনার এবং মেরামত করার প্রস্তাব আছে। সব কটি পর্ব শেষ হলে ভোলা বাদে রেলবঞ্চিত বাকি ১৯টি জেলায় ট্রেন চলবে। দরকার সেবামুখী প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে সময়মতো কাজ শেষ করা।

রেল খাতে চলমান ৪৮টি প্রকল্প মহাপরিকল্পনার প্রথম পর্বে (২০১৭-২০) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আরও ৩৫টির মতো প্রকল্প ঢোকার কথা। রেলওয়ের পদস্থ একটি সূত্র বলেছে, সব কটি কাজই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। ২০২০ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

যাত্রীসেবা বনাম পছন্দের প্রকল্প

গত ১০ বছরে গোপালগঞ্জসহ কিছু এলাকায় রেললাইন নির্মিত হয়েছে। আবার ঢাকা-টঙ্গী পথে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর ট্রেন চলে। এই পথে আরও দুটি রেললাইন নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ২০১২ সালে। ঠিকাদার নিয়োগ দিতেই ছয় বছর পেরিয়ে গেছে।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে যাত্রীর উপচে পড়া ভিড়। এই পথে আরেকটি রেললাইন নির্মাণের জন্য দুই বছর মেয়াদি প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৪ সালে। কাজ এগিয়েছে মাত্র ৫২ শতাংশ। এদিকে এই পথে চালানোর জন্য রেল কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালে চীন থেকে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ২০টি ডেমু ট্রেন কিনেছিল। ট্রেনটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করলে কারিগরি জটিলতা দেখা দেয়। পরে ট্রেনগুলো কম ভিড়ের পথে দেওয়া হয়।

রেলওয়ের একাধিক তদন্ত বলছে, ডেমু ট্রেন বাংলাদেশের উপযোগী নয়। বসে আর দাঁড়িয়ে শ তিনেক যাত্রী ধরে ডেমুতে। এর বেশি যাত্রী উঠলে ডেমু অকেজো হয়ে যায়। দেশে এর সারাইয়ের ব্যবস্থা নেই। এখন ১১টি ডেমুই নষ্ট পড়ে আছে।

নতুন করে ৩০টি ব্রডগেজ ডেমু কেনার জন্য সোয়া ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন রেলমন্ত্রী ডেমু কেনাকে নিরুৎসাহিত করেছেন।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) রেলের উন্নয়ন নিয়েও কাজ করে। পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের মতে, রেলের কর্মকর্তারা প্রকল্পের অগ্রাধিকার ঠিক করতে পারেন না। দুর্নীতি আর রাজনৈতিক বিবেচনাও থাকে। রেলের ওয়ার্কশপগুলোতে বিনিয়োগ করলে আমদানি-নির্ভরতা কমত। কিন্তু সেটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। আমদানি প্রকল্পে দুর্নীতির সুযোগ থাকে।

আবু নাসের প্রথম আলোকে বলেন, এই মৌলিক জায়গাগুলো ঠিক করা না গেলে রেলের লোকসানও কমবে না, সেবাও বাড়বে না।