আট দিনের ব্যবধানে শিশু-কিশোর 'মাফিয়া' গ্যাংয়ের হাতে দুই কিশোর খুন, বলছে পুলিশ

নিহত কিশোর আরিফ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
নিহত কিশোর আরিফ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

‘মাফিয়া’ গ্যাংয়ের চার শিশু সদস্য আরিফ হোসেনকে (১৫) হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। কীভাবে আরিফকে হত্যা করা হয়, তার বর্ণনা আদালতে দিয়েছে আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুরা। পুলিশ বলছে, মাফিয়া গ্যাংয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল ১০ বছর বয়সী এক শিশু। সে তার কাছে থাকা সবুজ রঙের সুইচ গিয়ার চাকু দিয়ে প্রথমে আরিফের বুকে আঘাত করে। এরপরই এলাকা ছেড়ে যায় তারা।

মাত্র আট দিনের ব্যবধানে কিশোর গ্যাং সদস্যদের হাতে চানখাঁরপুলের আশপাশে দুই কিশোর খুন হয়। কিশোর আরিফ হোসেন খুনের (১৫ মার্চ) আগে ৭ মার্চ চানখাঁরপুল-সংলগ্ন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দক্ষিণ পাশে কিশোর সিজানকে (১৫) খুন করা হয়। পুলিশ বলছে, চকবাজার ও বংশাল এলাকায় অন্তত সাত থেকে আটটি গ্রুপ আছে। প্রতিটি গ্রুপে সদস্য ৩০ থেকে ৪০ জন। এরা এলাকার বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ছয়জন শিশু-কিশোর আরিফ হোসেনকে নৃশংসভাবে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে। চারজন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে। এদের বয়স ১০ থেকে ১৫ বছর। এই শিশু-কিশোরদের গ্যাংয়ের নাম ‘মাফিয়া’। এর সদস্য ১২ জন। রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, হাইকোর্ট মাজার, দোয়েল চত্বর ও চানখাঁরপুল এলাকায় ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে আসছিল এই গ্যাংয়ের সদস্যরা।

১৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল-সংলগ্ন ফুটপাতে আরিফ হোসেন নামের এক কিশোর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। এ ঘটনায় আরিফের চাচাতো ভাই নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় সেদিন খুনের মামলা করেন। মামলার পর আরিফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ছয় শিশুকে গ্রেপ্তার করে শাহবাগ থানার পুলিশ। ছয় শিশুর মধ্যে চারজন আরিফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের নির্দেশে ছয় শিশুকেই টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।

নিহত আরিফের স্বজন ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরিফের বয়স ছিল ১৫ বছর। কিশোরগঞ্জের একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ত সে। বাবা হেলাল মিয়া ব্রেইন স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে আছেন ১০ বছর। আরিফের বড় ভাই আওলাদ পুরান ঢাকার একটি স্যান্ডেল কারখানায় কাজ করেন। স্কুলে ছুটি থাকলে ভাইয়ের কারখানায় খণ্ডকালীন কাজ করত আরিফ। শুক্রবার (১৫ মার্চ) ছুটির দিন হওয়ায় ভাই আওলাদসহ অন্যদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার জন্য হাইকোর্ট মাজারের মাঠে আসে আরিফ। খেলা শেষে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় কার্জন হলের সামনে দিয়ে আরিফসহ অন্যরা নাজিমুদ্দিন রোডের বাসায় ফিরছিল। কার্জন হলের সামনের ফুটপাত দিয়ে যাওয়ার সময় এক শিশু আরিফের গায়ে লেবুর খোসা ছুড়ে মারে। আরিফ তখন গালি দেয়। সঙ্গে সঙ্গে কিশোর গ্যাং ‘মাফিয়া’ দলের সদস্যরা আরিফকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। মারপিট করে। তাদের একজন আরিফকে জাপটে ধরে। তখন গ্যাংয়ের নেতা ১০ বছর বয়সী একটি শিশু চাকু দিয়ে আরিফের পিঠে আঘাত করে। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় আরিফকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেদিন রাত ১০টায় তার মৃত্যু হয়।

নিহত কিশোর সিজান (ফাইল ছবি)
নিহত কিশোর সিজান (ফাইল ছবি)



আদালতকে শাহবাগ থানা-পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, এই শিশুরা সেদিন কার্জন হলের সামনে লেবুর শরবত খাওয়ার পর আরিফের গায়ে লেবুর খোসা ছুড়ে মারে। আরিফ তাদের গালি দেয়। তখন আরিফকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে ছুরিকাঘাত করে তারা পালিয়ে যায়।

খুনের আগে ছিনতাই
শাহবাগ থানার এসআই মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আরিফ হোসেনকে খুন করার আগে মাফিয়া গ্যাংয়ের সদস্যরা হাইকোর্ট মাজার এলাকায় ছিনতাই করে। যে শিশুটি আরিফ হোসেনকে ছুরিকাঘাত করে, সে খুব ধূর্ত ও দুর্ধর্ষ। ছুরি দিয়ে আঘাত করার পর দলের এক সদস্যকে ওই শিশু বলেছিল, ছুরি ভালো করে ধুয়ে ফেলতে, যাতে হাতের ছাপ বোঝা না যায়। আটক করার পর ওই কিশোর বলেছিল তারা মোবাইল ছিনতাই করে না। মোবাইল ছিনতাই করলে ধরা পড়ার আশঙ্কা বেশি। মোবাইল ট্র্যাকিং করে সহজে পুলিশ ধরে ফেলে।

মনজুর হোসেন আরও বলেন, মাফিয়া গ্যাংয়ের প্রধান কিশোরটির বয়স ১৫ বছর। সেকেন্ড ইন কমান্ড, যে কিনা আরিফকে হত্যা করেছে, তার বয়স ১০ বছর। আইনের সংস্পর্শে আসা এসব শিশুর বয়স খুবই কম। কিন্তু খুনসহ মারাত্মক সব অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তারা জড়িত। দুই বছর ধরে মাফিয়া গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত।

কিশোর আরিফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত শিশুদের সবার বাড়ি চানখাঁরপুলের আশপাশে। তারা নাজিমুদ্দিন রোড, হোসেনি দালান, চকবাজার ও বংশাল এলাকায় থাকে।

মামলার বাদী ও নিহত আরিফ হোসেনের চাচাতো ভাই নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আরিফের বাবা ১০ বছর ধরে গুরুতর অসুস্থ। ব্রেইন স্ট্রোক করার পর থেকে তিনি শয্যাশায়ী। তাঁর বড় ছেলে আওলাদ ঢাকায় চাকরি করে সংসার চালিয়ে আসছিলেন। ছুটি পেলে নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া আরিফ ঢাকায় ভাইয়ের কাছে এসে কাজ করত। আরিফ ছিল খুব শান্ত ও ভদ্র। তার মতো ভালো ছেলে হয় না।