অর্ধেক চালকেরই লাইসেন্স নেই
>• সড়কে বিশৃঙ্খলা
• নিরাপত্তার প্রধান অনুষঙ্গ সড়ক, যানবাহন এবং চালক—কোনোটিই ত্রুটিমুক্ত নয়
• সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে না
• দেশে নিবন্ধিত যান ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার ৪২২, চালক আছেন প্রায় ২০ লাখ
• দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০–এর মধ্যে
• ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে
বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৩৮ লাখের বেশি। কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহনের জন্য লাইসেন্সধারী চালক আছেন প্রায় ২০ লাখ। অর্থাৎ ৪৭ শতাংশের বেশি গাড়ি চলছে ‘ভুয়া’ চালক দিয়ে।
অন্যদিকে দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের ৬২ শতাংশেই যথাযথ সাইন-সংকেতের ব্যবস্থা নেই। দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যাও প্রায় ৫ লাখ। সড়ক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রধান অনুষঙ্গ সড়ক, যানবাহন এবং চালক—এর কোনোটিই ত্রুটিমুক্ত নয়। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
গত বছরের আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। অনেক দিন আটকে থাকা সড়ক পরিবহন আইনটি দ্রুততার সঙ্গে পাস করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন না হওয়ায় সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলও থামছে না।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, গত চার বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৯ হাজার ৩১৫ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে সড়কে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে মারা গেছেন ৭ হাজার ২২১ জন। গতকাল শুক্রবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৬ জন।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সামনে বাসচাপায় মারা যান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী। আবরারকে চাপা দেওয়া বাসচালকেরও যথাযথ লাইসেন্স ছিল না। আবরারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা আনার ব্যর্থতার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। পুলিশ, পরিবহনমালিকেরা আগের প্রতিশ্রুতিগুলোই আবারও দিতে শুরু করেছেন।
লাইসেন্সহীন চালকের ছড়াছড়ি
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব বলছে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত যানবাহন আছে ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার ৪২২টি। আর বিআরটিএ সূত্র বলছে, বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহনের জন্য চালক লাইসেন্স আছে প্রায় ২৮ লাখ। এর মধ্যে একই লাইসেন্সে একজন ব্যক্তি মোটরসাইকেল ও অন্য যানবাহন চালান। এদের বাদ দিলে চালকের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২০ লাখ। অর্থাৎ ১৮ লাখ যানবাহন ‘ভুয়া’ চালক দিয়ে চলছে।
১৭ মার্চ থেকে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন শুরু করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। ট্রাফিক সপ্তাহে প্রতিদিন বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। ডিএমপি ট্রাফিকের উপকমিশনার (পশ্চিম) লিটন কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, অভিযানে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় বেশ কিছু বাস আটক করা হয়েছে। আবার হালকা যানের লাইসেন্স নিয়ে অনেক চালক বাস চালাচ্ছেন, এমনও পাওয়া যাচ্ছে।
যথাযথ সাইন-সংকেত নেই
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির অধীনে মোট সড়ক আছে ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক ৮ হাজার ৮৬০ কিলোমিটার। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব জরিপ বলছে, জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের মধ্যে ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার সড়কে যথাযথ সাইন-সংকেত নেই। কোথাও কোথাও থাকলেও তা ত্রুটিপূর্ণ। অর্থাৎ ৬২ শতাংশ জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে যথাযথ সাইন-সংকেত নেই। তবে যেসব সড়কে সঠিক সাইন-সংকেত নেই এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি আছে, সেসব সড়ক উন্নয়নে ৬৩২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে সওজ।
ফিটনেসবিহীন যানের দৌরাত্ম্য
বিআরটিএ সূত্র বলছে, বর্তমানে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৫ লাখের কাছাকাছি। মোটরযান আইনে ফিটনেস সনদ দেওয়ার আগে অর্ধশতাধিক কারিগরি ও বাহ্যিক দিক বিবেচনা করতে হয়। কিন্তু একজন মোটরযান পরিদর্শক দিনে শ খানেক যানের ফিটনেস সনদ দিয়ে থাকেন। ফলে যেসব যানবাহন সনদ পাচ্ছে, সেগুলোও যে চলার উপযুক্ত, তা জোর দিয়ে বলা যাবে না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা না ফেরাতে পারার দায় কম-বেশি সবার। তবে মালিকদের পক্ষ থেকে আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। বিআরটিএর যানবাহনের ফিটনেস যাচাই করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দক্ষ চালকের সংকট কাটাতে চালক প্রশিক্ষণ একাডেমি গড়তে হবে এবং লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করতে হবে।
ঝরছে তরুণ প্রাণ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণা অনুসারে, দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়াদের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর দুর্ঘটনায় নিহতদের সাড়ে ১৮ শতাংশ ১৫ বছরের নিচের শিশু। এই দুই শ্রেণিকে দেশের ভবিষ্যৎ ও অর্থনীতির মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার নামে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড চলছে। এসব দুর্ঘটনায় মেধাবী ও কর্মক্ষম জনসম্পদ হারিয়ে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। সরকার এখন পর্যন্ত যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন হলেও সড়ক দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশ কমানো সম্ভব।
বেপরোয়া গতিই দায়ী
সড়ক দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। বেপরোয়া গতিকে সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ হিসেবে মেনে নিয়ে ২০১৫ সালে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল মহাসড়কে বাসের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সড়ক নিরাপত্তার সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন করা যায়নি।
এআরআইয়ের সাম্প্রতিকতম এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে সংঘটিত ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ বাস। ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এ সময়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬৬৬টি। এর মধ্যে ৩৫৪টি দুর্ঘটনাই বাসের কারণে ঘটেছে। আর এসব দুর্ঘটনার বড় কারণ বেপরোয়া বাস চালানো।
অন্যদিকে গত চার বছরের সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ছাড়াও বিপজ্জনক ওভারটেকিং (পাল্লাপাল্লি), সড়ক-মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা এবং সড়কে ছোট যানবাহনের সংখ্যা বাড়ায় দুর্ঘটনা ঘটছে।
প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চাই
গত বছরের ২৫ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পাঁচটি নির্দেশনা দেন। এগুলো হলো দূরপাল্লায় বিকল্প চালক রাখা, যাতে একজন চালককে টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি চালাতে না হয়, নির্দিষ্ট দূরত্বে চালকদের জন্য বিশ্রামাগার করা, গাড়ির চালক ও তাঁর সহকারীকে প্রশিক্ষণ, সংকেত মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার বা অবৈধভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর সওজ চার মহাসড়কের চারটি স্থানে বিশ্রামাগার স্থাপন করতে একটি প্রকল্প নিয়েছে। অন্য নির্দেশনা বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই।
গত বছর নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি কমিটি করা হয়। কমিটি বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করে। যার অধিকাংশই ছিল রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে। এই নির্দেশনাগুলোর বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি হয়নি, ফলে রাজধানীর সড়কেও শৃঙ্খলা ফেরেনি। গত বৃহস্পতিবার সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে না পারার দায় স্বীকার করে বক্তব্য দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
সড়কের নৈরাজ্য বন্ধে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই বলে মনে করেন বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহন খাতে মালিক এবং শ্রমিক সমিতি যা চাইছে, তা-ই হচ্ছে। এসব সমিতির বিপক্ষে গিয়ে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার মতো সক্ষমতা এবং জনবল কোনোটাই সরকারি সংস্থাগুলোর নেই। এসব নির্দেশ বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সাধারণ নাগরিকসহ সব পক্ষের সদিচ্ছা প্রয়োজন।