ধান-গম ছেড়ে ভুট্টায় ঝুঁকছেন কৃষক

>

ধান ও গম চাষে খরচ বেশি। এসব বিক্রি করে বেশি লাভও হয় না। অথচ ভুট্টায় উৎপাদন খরচ কম ও লাভ বেশি হয়।

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলায় এবার গমের আবাদ কমে গেছে। বোরো ধানের আবাদের প্রতিও আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষক। বেশি লাভ ও উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় তাঁরা ভুট্টা চাষে ঝুঁকেছেন।

উপজেলার কয়েকজন কৃষক বলেন, গত বছর গম চাষ করে প্রতি বিঘায় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ এবং এবার আমন ধানে প্রতি বিঘায় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা লোকসান হয়েছে। এই কারণে চলতি মৌসুমে গম ও বোরো ধান আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অনেক কৃষক। গত মৌসুমের তুলনায় পীরগঞ্জ উপজেলায় এবার ১ হাজার ৩০০ হেক্টর কম জমিতে গম আবাদ হয়েছে।  বোরো ধানের আবাদও কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম এবং মো. আবদুর রহিম জানান, গম চাষের জন্য প্রচণ্ড শীত ও ঘন কুয়াশার প্রয়োজন হয়। গমগাছ বৃদ্ধির জন্য ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তীব্র শীত থাকা দরকার, যা দুই-তিন বছর থেকে অনুপস্থিত। গত মৌসুমে (২০১৭-১৮) পীরগঞ্জে প্রতি একরে ১ দশমিক ৪০ মেট্রিক টন, এর আগের মৌসুমে (২০১৬-১৭) ১ দশমিক ৪৪ মেট্রিক টন এবং ২০১৫-১৬ মৌসুমে ১ দশমিক ৪৯ মেট্রিক টন গম হয়েছিল। গত দুই মৌসুমে এখানে তুলনামূলক শীত ও কুয়াশা কম ছিল। এ জন্য গত দুই মৌসুমে উপজেলায় গমের ফলন কম হয়েছে। এতে চাষিরা গমের আবাদ কমিয়ে দিয়েছেন। গত বছর উপজেলায় গম চাষ হয়েছিল ১৩ হাজার ৬০০ হেক্টরে। এবার হয়েছে ১২ হাজার ৩০০ হেক্টরে।

উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পীরগঞ্জ উপজেলায় আবাদি জমি ২৯ হাজার ৬১ হেক্টর। এর মধ্যে এবার ৪ হাজার ২০০ হেক্টরে ভুট্টা এবং ১৩ হাজার ১৬৮ হেক্টরে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর উপজেলায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা এবং ১২ হাজার ৮০০ হেক্টরে বোরো ধান আবাদ হয়েছিল। এবার গত রোববার পর্যন্ত  উপজেলায় ৪ হাজার ১৫৫ হেক্টরে ভুট্টার আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের আবাদের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। ১৪ মার্চ পর্যন্ত ভুট্টা আবাদ চলবে। এ সময়ের মধ্যে আরও কয়েক শ হেক্টরে ভুট্টার আবাদ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

উপজেলায় এবার ২ হাজার ১৫০ হেক্টরে সরিষার চাষ হয়েছে। চাষিরা সাধারণত সরিষার পরে জমিতে বোরো ধান আবাদ করতেন। কিন্তু এবারের আমন ও গতবার বোরো ধানে উপর্যুপরি লোকসান হওয়ায় কৃষকেরা এবার সরিষা তুলে ধানের বদলে ভুট্টার আবাদ করছেন।  

ভুট্টা আবাদের কারণ সম্পর্কে ঘুঘুয়া গ্রামের ইউসুফ আলী বলেন, ‘গতবার সরিষা কেটে বোরো চাষ করে লস খেয়েছি। সরিষার জমিটা উঁচু হওয়ায় বোরোর জন্য সেচ দিতে বেশি টাকা খরচ হয়। আর ওই জমিতে ভুট্টা চাষ করলে বেশি সেচের দরকার হয় না। ভুট্টায় খরচও কম। তাই এবার আমি ভুট্টা চাষ করব। ভুট্টা আবাদ করে ফলন বেশি হয় এবং বিক্রি করে লাভও পাওয়া যায় বেশি। এ ফসলে লোকসানের ঝুঁকি কম।’

শীতলপুর গ্রামের খেজমত আলী, আরাজি আলমপুর গ্রামের কোবাদ আলী, মালঞ্চা গ্রামের আনন্দ মোহন, চাপোড় গ্রামের তুলসী চন্দ্র রায়, দৌলতপুর গ্রামের নেন্দ রায়সহ একাধিক কৃষক সরিষা তুলে ভুট্টা আবাদের জন্য জমি তৈরি করছেন।

কুশারীগাঁও গ্রামের মো. মুনিরউদ্দীন জানান, গত মৌসুমে তিনি গম চাষ করে প্রতি বিঘায় ১৬ মণ ফলন পেয়েছিলেন। ৬০০-৬২০ টাকা মণ দরে গম বেচে তাঁর লাভ হয়নি, বরং বিঘাপ্রতি লোকসান হয়েছে প্রায় এক হাজার টাকা। তিনি আরও জানান, গমের জমি তৈরি, সার, জৈব সার, ভিটামিন, গম কাটা, আঁটি বাঁধা, বহন, পালা করা, মাড়াইসহ সব মিলিয়ে ১১ হাজার থেকে ১১ হাজার ৫০০ টাকা খরচ পড়েছে।  অথচ ১৬ মণ গম বেচে পাওয়া গেছে ১০ হাজার ৮০ টাকা।

আকাশিল গ্রামের আবুল কাশেম, দৌলতপুর গ্রামের তবারক আলী ও সুরেশ চন্দ্র রায় জানান, এক বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করতে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ হয়। বিঘাপ্রতি ফলন পাওয়া যায় ৫০-৬০ মণ। প্রতি মণ ভেজা ভুট্টা ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। এতে বিঘাপ্রতি ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা লাভ হয়।

নারায়ণপুর গ্রামের আব্বাস আলী ও বৈরচুনা গ্রামের গোলাম রসুল জানান, বোরো ধান আবাদে বিঘাপ্রতি উৎপাদন খরচ পড়ে ১০ হাজার থেকে ১১ হাজার টাকা। অথচ বিঘাপ্রতি বোরো ধানের ফলন পাওয়া যায় ২৫-৩০ মণ। ধান কাটা–মাড়াইয়ের সময় প্রতি মণ ভেজা ধানের দাম পাওয়া গেছে ৪০০-৪৫০ টাকা।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা লায়লা আরজুমান বেগম  বলেন, গত মৌসুমে গমে এবং এবারের আমনে লোকসান হওয়ায় বেশির ভাগ চাষি এবার গম ও বোরো আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে ভুট্টার আবাদের দিকে ঝুঁকেছেন।