অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই গড়ে উঠছে বহুতল ভবন

>
  • বেশির ভাগ বহুতল ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা আইন নেই
  • রাজউক থেকে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্রসহ নকশার অনুমোদন নিতে হয়
  • ছয়তলার ওপর আবাসিক ভবন নির্মাণ করতে হলে ফায়ার সার্ভিস থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে

রাজধানীতে বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু দুটি আইনে বহুতল ভবনের সংজ্ঞা দুই রকম হওয়ায় অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছাড়াই বেশির ভাগ আবাসিক ভবন গড়ে উঠছে।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, ছয়তলার ওপর আবাসিক ভবন নির্মাণ করতে হলে ফায়ার সার্ভিস থেকে অগ্নিপ্রতিরোধ–সংক্রান্ত ছাড়পত্র নিতে হবে। কিন্তু রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বলছে, ভবনের উচ্চতা ১০ তলা না হলে এই ছাড়পত্রের প্রয়োজন নেই। 

এই বিতর্কের পেছনে রয়েছে ২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা এবং ২০০৩ সালের অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন। ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বহুতল ভবনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ১০ তলা বা ৩৩ মিটারের ঊর্ধ্বে যেকোনো ভবন। আর অগ্নিপ্রতিরোধ আইনে অন্যূন সাততলাবিশিষ্ট ভবনকে বহুতল ভবন বলা হয়েছে। আইনগত এই অসংগতির কারণে ঢাকার ৭, ৮ ও ৯ তলা ভবনগুলো গড়ে উঠছে কোনো ধরনের অগ্নিনিরাপত্তা–ব্যবস্থা ছাড়াই।

গত বৃহস্পতিবার রাতে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অগুন লাগার পর রাজধানীর ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে।

ঢাকা শহরে কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে রাজউক থেকে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্রসহ নকশার অনুমোদন নিতে হয়। ১০ তলা বা তার চেয়ে উঁচু ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভবনমালিককে ফায়ার সার্ভিস থেকে অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত ছাড়পত্র আনতে বলে রাজউক। কিন্তু উচ্চতা ১০ তলার কম হলে রাজউক এই ছাড়পত্র চায় না। ফলে ভবনমালিকেরাও ফায়ার সার্ভিসে যান না।

রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) অংশ হিসেবে ২০১৬ সালে করা এক ভৌত জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা মহানগর এলাকায় সাততলা বা তার চেয়ে উঁচু ভবন আছে ১৬ হাজার ৯৩০টি। গত দুই বছরে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। অগ্নিপ্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, এসব ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ৫ হাজার ২৪টি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এই ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছে।

সরেজমিনে মোহাম্মদপুরের কাটাসুর এলাকায় ১০টি আবাসিক ভবনে (ছয়তলার ওপর) গিয়ে দেখা গেছে, কোনোটিতেই অগ্নিনিরাপত্তার ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা নেই। অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থা কেন নেই, তা জানতে চাইলে দুটি ভবনের মালিক বলেন, আইনগত বাধ্যবাধকতার বিষয়টি তাঁরা জানতেন না। রাজউক থেকে ভবনের নকশা অনুমোদনের সময়ও তাঁদের এ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।

২০০৩ সালের অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইনের ৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী, অন্য আইনে যা–ই থাকুক না কেন, অগ্নিপ্রতিরোধ, অগ্নিনির্বাপণ এবং এ–সংক্রান্ত নির্ধারিত বিষয়াদির ক্ষেত্রে মহাপরিচালকের (ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর) ছাড়পত্র ছাড়া কোনো বহুতল ভবন বা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন বা অনুমোদিত নকশার সংশোধন করা যাবে না।

জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (ওয়্যারহাউস অ্যান্ড ফায়ার প্রিভেনশন) ওহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সময় ছয়তলা পর্যন্ত উচ্চতার ভবন থেকে মই দিয়ে মানুষজনকে বের করা যায়। কিন্তু এর চেয়ে উঁচু ভবন হলে অগ্নিকাণ্ডের সময় ভেতরে আটকে পড়া মানুষজনকে বের করা কষ্টসাধ্য। এতে হতাহতের শঙ্কা বাড়ে। তাই ভবনের উচ্চতা সাততলা হলেই অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে। আর বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে যেকোনো উচ্চতার ভবনের ক্ষেত্রেই অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখতে হয়।

ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা অগ্নিনিরাপত্তার স্বার্থে বর্তমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালাটি সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁদের মতে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালাটি সংশোধন করে বহুতল ভবনের সংজ্ঞা অগ্নিপ্রতিরোধ আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে সাততলা থেকে নির্ধারণ করতে হবে। এতে ফায়ার সার্ভিস থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার হার বাড়বে এবং অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিও কমবে।  

যোগাযোগ করা হলে রাজউকের অঞ্চল-৫–এর পরিচালক মো. শাহ আলম চৌধুরী বলেন, রাজউক তার বিধি অনুযায়ী ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়। ৭, ৮ ও ৯ তলা ভবনেও যদি অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়, তবে ফায়ার সার্ভিস তাদের পর্যবেক্ষণ আনুষ্ঠানিকভাবে রাজউক কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারে। পরবর্তী সময়ে রাজউক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।