আনন্দের অন্বেষণে ছুটছি: মুর্তজা বশীর
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, মুর্তজা বশীর বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি চিত্রশিল্পী, কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত, মুদ্রা তত্ত্ব বিশারদ। এই বহুমুখী প্রতিভার মানুষ সম্পর্কে অল্প কিছু বলা মুশকিল।
আজ শনিবার বিকেলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বাতিঘর বই বিক্রয় কেন্দ্রে মুর্তজা বশীরের ওপর মিরাজুল ইসলামের লেখা ‘নার্সিসাসে প্রজাপতি’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আনিসুজ্জামান এসব কথা বলেন।
আর চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বললেন, ‘আমি কবিতা, উপন্যাস লিখেছি। সবকিছু করেছি কিন্তু আনন্দ খুঁজে পাইনি। আমি আনন্দের অন্বেষণে ছুটছি। আনন্দ যে কোথায়, তা আমি খুঁজে পাচ্ছি না।’
আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আমি যত লেখক ও শিল্পী সম্পর্কে বলেছি ও লিখেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লিখেছি বা বলেছি মুর্তজা বশীর সম্পর্কে। বিশেষ করে বশীরের ৫০ বছর পূর্তিতে আমি যে বক্তৃতা দিয়েছি, তা আমার সেরা বক্তৃতার একটি বলে মনে করি। মিরাজুল ইসলাম যে বইটি লিখেছেন, সেখানে মুর্তজা বশীরের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ পরিচয়ের সূত্রে চিত্র ও চরিত্র সম্পর্কে বলার চেষ্টা করেছেন। মুর্তজা বশীরের মধ্যে ভালোবাসা যেমন আছে, তেমনি একটা নির্মমতাও আছে। তিনি এ রকম একজন বড় শিল্পী হয়েও মাঝে মাঝে অনেক লম্বা ছেদ টেনেছেন। অনেক বছর ছবি আঁকেননি। এটা কী করে সম্ভব হয়েছে? যিনি চিত্রকর, ছবিকে ভালোবাসেন তিনি ছবি না এঁকে থাকতে পারেন কী করে। আমরা মুর্তজা বশীররের দীর্ঘ জীবন কামনা করি। শিল্পী, লেখক, ইতিহাসবিদ হিসেবে অনেক দিয়েছেন আরও দেবেন। তার পরিবর্তে আমরা তাঁকে ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা দেব।’
অনুষ্ঠানে মুর্তজা বশীর বলেন, ‘আনিসুজ্জামান আমাকে খুব ভালোবাসেন। তিনি এত ব্যস্ত মানুষ তবুও আমাকে নিয়ে লিখেছেন। আমাদের দেশে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবন আছে। এখনো এ দেশে ব্যক্তিগত জীবন প্রকাশ করার সুযোগ আসেনি। হাসনাত আবদুল হাইকে আমি একটা সময় আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে লিখতে দিইনি কিন্তু এখন বলছি আপনি লেখেন। আমি কবিতা, উপন্যাস লিখেছি। সবকিছু করেছি কিন্তু আনন্দ খুঁজে পাইনি। আমি আনন্দের অন্বেষণে ছুটছি। আনন্দ যে কোথায়, তা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কখনো মনে হয়েছে পরিবারের সঙ্গে, কখনো মনে হয়েছে সারা রাত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, কখনো ছবি এঁকে, কবিতা লিখে। কিন্তু এই ৮৭ বছর বয়সেও আমি আনন্দ খুঁজে পাচ্ছি না। আমার কাছে আনন্দটা মনে হয় আলেয়ার মতো।’
মিরাজুল ইসলামের লেখা বইয়ের কথা বলতে গিয়ে মুর্তজা বশীর বলেন, ‘যে বইটি লিখেছে তাতে আমার ব্যক্তিগত দুটি ঘটনা আছে। আমি অতীত ও বর্তমানকে বিশ্বাস করি না আমি আগামীকে বিশ্বাস করি। ভোরের কাগজে পাঁচ বছর আগে একবার আমার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। আমার কাছে জানতে চেয়েছিল আপনি কী হিসেবে বেঁচে থাকতে চান? আমি বলেছিলাম একজন সৎ ও দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে।’
লেখক হাসনাত আবদুল হাই বলেন, ‘প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন মানুষ মুর্তজা বশীর। শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি সব বিষয়ে অসম্ভব দখল তাঁর। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এত ঘটনার সমাহার তাঁর জীবনে যে তাঁকে নিয়ে অনেক কিছু লেখার আছে। এই বইটি ব্যতিক্রমভাবে লেখা হয়েছে। আশা করি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।’
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘মুর্তজা বশীরের গল্প–কবিতা পড়েছি। তিনি আমাদের সময়ের আদর্শ। দেশের জন্য আরও অবদান রাখুন। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন সক্রিয় থাকুন।’
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ১৯৫৫ ও ৫৬ সালে নবাবপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন অঙ্কন শিক্ষক হিসেবে পান মুর্তজা বশীরকে। একবার ডাস্টার দিয়ে আঙুলে মেরেছিলেন, সেই স্মৃতি এখনো আছে। ৫৬ সালে স্কুলে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার কথা উল্লেখ করে মতিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের স্কুলের অঙ্কনের সেরা ছাত্ররা সেখানে ছবি জমা দেয়। আমি ছবি আঁকতাম না। খেলা দেখি, মাঠে-ঘাটে ঘুরি, ক্লাস ফাঁকি দিই। নানা কিছুর মধ্যে থেকেও কিঞ্চিৎ উৎসাহিত হয়ে আমিও ছবি জমা দিই। প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন জয়নুল আবেদিন, মোহাম্মদ কিবরিয়া। দেবদাস চক্রবর্তীও হয়তো ছিলেন। আমাদের বিভাগে ও সারা স্কুলে আলাদাভাবে আমার ছবিটি হয় সেরা। যদিও সেটিই ছিল আমার প্রথম ও শেষ চিত্রাঙ্কন।’
মতিউর রহমান বলেন, ‘মুর্তজা বশীর বাংলাদেশের শিল্পজগতের একজন প্রধান শিল্পী। ষাট দশকের বেশি সময় ধরে তিনি এ কর্মযজ্ঞে জড়িত আছেন। এখনো তিনি সক্রিয়। এখনো তিনি আঁকেন, নানা কাজের মধ্য দিয়ে তার সময় কাটে। বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন রকমের ছবি এঁকেছেন। তৈলচিত্র, জলরং, প্যাস্টেল, ছাপচিত্র সবকিছু তিনি দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। আরও আনন্দের ও বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, শিল্পকলা বিষয়ে বেশ কিছু লেখালেখি করেছেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো প্রাচীন মুদ্রা নিয়ে তাঁর গবেষণা। দেখে বিস্মিত হতে হয় যে, একজন মানুষ একসঙ্গে কত কিছু করতে পারেন। তিনি অটোগ্রাফ, ডাকটিকিট, ম্যাচ বাক্স সংগ্রহ করেন। সবকিছু করেছেন অতি নিষ্ঠার সঙ্গে। তার বর্ণাঢ্য জীবন আমাদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে। ছাত্র হিসেবে তাঁর কর্মযজ্ঞ অনুভব করার চেষ্টা করি এবং আমাদের জীবনের কার্যক্রমে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করি।’
বক্তব্যের শেষে মুর্তজা বশীরের ‘তুমি স্বদেশ’ ও ‘এসো’ কবিতা আবৃত্তি করেন মতিউর রহমান।
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘তাঁর গত জন্মদিনে তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তাঁর কাছে অটোগ্রাফ চাইলাম, তিনি একটি ছবি এঁকে দিলেন। এটা আমার কাছে অমূল্য এক সম্পদ। আমি যদি আমার আত্মজীবনী লিখি, তাহলে সেখানে এই ছবি আর ঘটনাটি লিখব। তিনি সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন।’
বইটির লেখক মিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মুর্তজা বশীরকে নিয়ে সবার আরও পড়া দরকার। ৮০ বছর পেরিয়েছে এমন জীবিত শিল্পী একমাত্র তিনি। এখনো তাঁর অনেক কিছু দেওয়ার আছে।’
অনুষ্ঠানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক গোলাম সারওয়ার চৌধুরী, শিল্পী মনসুর উল করিম, প্রতীক প্রকাশনীর নূরই মোনতাকিম আলমগীর প্রমুখ বক্তৃতা দেন। সঞ্চালনা করেন লেখক লুৎফুল হোসেন।
বইটি প্রকাশ করেছে প্রতীক প্রকাশনী।