বেশি পরিমাণে ভাত খাওয়া, ভ্রাম্যমাণ ভ্যান বা দোকানে তৈরি নানা পদের মসলাদার খাবার এবং অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি, লবণ খাওয়াও বস্তিবাসীর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস হওয়ার জন্য দায়ী। কাজের ও জীবনধারায় পরিবর্তন বস্তিবাসীদের স্থূল হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ
শহুরে বস্তির বাসিন্দারা স্থূল হচ্ছেন। তাঁদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হচ্ছে এবং ডায়াবেটিস রোগের মাত্রাও বাড়ছে। এতে তাঁরা অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে আছেন এবং আক্রান্তও হচ্ছেন। ঢাকার বস্তিবাসীদের স্থূল হওয়ার হার জাতীয় গড় স্থূল হারের চেয়েও বেশি।
স্বাস্থ্যবিষয়ক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটির নাম ‘ঢাকার বস্তি বাসিন্দাদের মধ্যে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকির প্রাদুর্ভাব: জনগোষ্ঠীর সব স্তর ভিত্তিক জরিপ’। গবেষণার ফলাফল বলছে, বস্তির নারীদের স্থূলতার হার ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ এবং পুরুষদের ১৯ শতাংশ।
বস্তিবাসীরা অসংক্রামক রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন উল্লেখ করে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশি পরিমাণে ভাত খাওয়া, ভ্রাম্যমাণ ভ্যান বা দোকানে তৈরি নানা পদের মসলাদার খাবার এবং অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি, লবণ খাওয়াও বস্তিবাসীর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস হওয়ার জন্য দায়ী। কাজের ও জীবনধারায় পরিবর্তন বস্তিবাসীদের স্থূল হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। বস্তির পুরুষের তুলনায় নারীরা কায়িক পরিশ্রম কম করে থাকেন। তাই নারীদের মোটা হওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে। এমনকি শহরের বস্তির নারীরা গ্রামের নারীদের তুলনায়ও কম পরিশ্রম করে থাকেন।
এই জরিপের মাধ্যমে বাংলাদেশের শহুরে গরিবদের মধ্যে অসংক্রামক রোগের উচ্চ ঝুঁকি দেখা গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বস্তির বাসিন্দারা ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিতে আছেন। তাঁদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন এবং কম ওজনও দেখা গেছে। স্বাস্থ্যগত এসব সমস্যার কারণে বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক বোঝা বাড়ছে।
১২ জনের গবেষক দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই গবেষণার মধ্য দিয়ে আমরা নগরীর বস্তির মানুষদের অসংক্রামক রোগসংক্রান্ত ঝুঁকির জায়গাগুলো জানার চেষ্টা করেছি। সরকারের নীতিনির্ধারক, স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থা ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো যারা বস্তিবাসীদের নিয়ে কাজ করে, তারা এই জরিপের ফলাফল থেকে একটা সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পাবে। বস্তির মানুষদের জীবনের মানোন্নয়নে অসংক্রামক রোগ নিয়ে সচেতনতায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে এই জরিপ সরকারকে সাহায্য করবে।’
এ প্রসঙ্গে সরকারের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর নূর মোহাম্মদ জানান, শহরে বস্তিবাসীদের মধ্যে অসংক্রামক রোগের প্রকোপ নিয়ে কোনো সরকারি জরিপ বা আলাদা কোনো প্রকল্প নেই। তবে স্বাস্থ্যগত এসব বিষয়ে সচেতনতার জন্য ঢাকার ৭০০টি পয়েন্টে পোস্টার ও সাইনবোর্ড আছে। বস্তির মানুষদের সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটিভিত্তিক প্রকল্প নেওয়ার পরিকল্পনা সরকার করছে বলে জানান তিনি। নূর মোহাম্মদ বলেন, বস্তিবাসী এনার্জি ড্রিংকস, ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত চিনি, তেলেভাজা খাবার—এসব বেশি পরিমাণে খেয়ে থাকে। তাঁরা স্বাস্থ্যের বিষয়ে বেশ অসচেতন। এই কারণে তাঁদের হৃদ্রোগ, শ্বাসকষ্ট, ক্যানসারের মতো বিভিন্ন অসংক্রামক রোগও হচ্ছে।
উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ে এই গবেষণার ফলাফলের সত্যতা মিলল মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধ বস্তির বাসিন্দা লাভলী বেগমের কথায়। ৪৮ বছর বয়সী এই ডিম বিক্রেতার পরিবারের ছয়জনের মধ্যে তিনজনেরই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে এবং একজন কিডনির রোগে ভুগছেন। তিন বছর ধরে নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে হচ্ছে লাভলী বেগমকে। প্রতি মাসে তাঁর পরিবারে এক কেজি মোটা ও এক কেজি চিকন লবণ লাগে। পরিবারের সদস্যরা খোলা লবণ বেশি খায় বলে জানিয়েছেন লাভলী বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার শাশুড়ির কিডনির সমস্যা। আমি সকাল সাতটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত দোকানদারি করি। বইসা থাকি, পরিশ্রম খুব একটা করা হয় না। এক বছর আগেও ওজন ৬৫ কেজি ছিল। এখন ৭২ হইছে। আমার শরীর চাবায়, গা ব্যথা করে। কিন্তু আমরা ডাক্তারের কাছে যাই না। শইল খারাপ হইলে বাজারের ডিসপেনসারি থেইকা ওষুধ কিনি।’
অতি ওজনের কারণে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন একই বস্তির বাসিন্দা শাহনাজ আক্তার। নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ না খাওয়ায় বছরখানেক আগে স্ট্রোক হয়েছিল তিনি। তাঁর স্বামীর উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস দুটিই আছে। প্রতি মাসে রান্নার জন্য ৬ থেকে ৭ কেজি সয়াবিন তেল লাগে। প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫টি পান খান তিনি। তিনি বলেন, ‘ভাত না হলেও চলবে, কিন্তু পান খাওয়া চাই। ফল কইত্তে খামু। তয় শাকসবজি খাই।’
১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়। জরিপের জন্য ঢাকার মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধ বস্তির ২ হাজার ৯৮৬টি পরিবারের ২০০৯ জনের শারীরিক ও স্বাস্থ্যগত তথ্য নেওয়া হয়। এরপর তথ্য পর্যালোচনা করে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ওপেনে গবেষণাটি প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত জরিপটি চালানো হয়।