প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি গারো পাহাড়ের চারদিকে সবুজের মায়াময় পরিবেশ। ওপরে নীল আকাশ, নিচে লাল-সবুজের টিলার সমারোহ। অপরূপ নৈসর্গিক এই সৌন্দর্যের দৃশ্য শেরপুরের পর্যটনকেন্দ্র ‘মধুটিলা ইকোপার্ক’–এর।
শেরপুর সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলার শমশ্চূড়া বিটের ৪০ হেক্টর বনভূমিজুড়ে গড়ে উঠেছে এই পার্কটি। চলতি শীত মৌসুমে বিপুলসংখ্যক পর্যটক আর ভ্রমণপিপাসুর পদচারণে এটি এখন মুখর।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মধুটিলা ইকোপার্কটি ২০০৫ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প হিসেবে ১ কোটি ৬৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়। এ পার্কের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা, পাশাপাশি এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একে একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা।
মধুটিলা ইকোপার্কে বিভিন্ন কারুকার্যময় শৈল্পিকতার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থাপনা। এর মধ্যে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্টার ব্রিজ, মিনি ব্রিজ আর কৃত্রিম লেক। আছে জলপরি, মৎস্যকন্যা, হাতি, সিংহসহ বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আছে রেস্টহাউস। রয়েছে অসংখ্য গাছগাছালি। মধুটিলার চূড়ায় উঠলে মন ভরে যায় আনন্দে। গারো পাহাড়ের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ১০০ ফুটেরও বেশি উচ্চতার পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এখানে উঠলে অবাক হয়ে শুধু চারদিকে তাকাতেই মন চাইবে। আশ্চর্য সব দৃশ্যপট। উত্তরে তাকালে চোখে পড়বে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সুউচ্চ পর্বতরাশি। নিচে তাকালে দেখা যাবে সুদৃশ্য স্টার ব্রিজ। ইকোপার্কের ভেতরে আছে মিনি চিড়িয়াখানা আর শিশুপার্ক। চিড়িয়াখানায় দেখা যাবে হরিণ, বানর, বনমোরগ, টার্কি, শকুন, খরগোশ আর লক্ষ্মীপ্যাঁচা। ইকোপার্কের বাড়তি সৌন্দর্যের জন্য রোপণ করা হয়েছে দুই শতাধিক প্রজাতির ফলদ ও বনজ বৃক্ষ। এখানে অনেক দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের কাজ অব্যাহত রয়েছে। এখানে আসা পর্যটকদের কেনাকাটার জন্য অর্ধশত দোকানপাটও স্থাপন করা হয়েছে।
গত শুক্রবার মধুটিলা ইকোপার্কে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাসফর এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের লোকজনসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিপুলসংখ্যক লোক বেড়াতে ও বনভোজন করতে এখানে এসেছেন। এসব ভ্রমণপিপাসুর পদচারণে মুখর হয়ে উঠেছে ইকোপার্ক এলাকা। এ সময় কথা হয়, ঝিনাইদহ থেকে আসা বসন্তপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখানে শিক্ষাসফর করতে এসে চমৎকার লাগছে। গারো পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি।’ এই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী শেফা বলেন, ‘এই প্রথম এখানে এসেছি। খুব ভালো লাগছে। বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ দেখে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি।’
ফরিদপুরে কর্মরত একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোফাজ্জল হোসেন সপরিবারে মধুটিলা ইকোপার্কে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘এই ইকোপার্কে এবারই প্রথম এসেছি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে খুব ভালো লাগছে। তবে চিড়িয়াখানা আর শিশুপার্কের আরও উন্নয়ন করা প্রয়োজন। যাতে শিশুরাও নির্মল বিনোদন পেতে পারে।’
জানতে চাইলে মধুটিলা ইকোপার্কের ইজারাদারের প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ৪০ লাখ টাকার বিনিময়ে এক বছরের জন্য তাঁরা এটি ইজারা নিয়েছেন। বন বিভাগের পক্ষ থেকে পার্কটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলে এটি পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে।
জানতে চাইলে ময়মনসিংহের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা প্রাণতোষ কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, মূলত জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার লক্ষ্যে বন বিভাগের পক্ষ থেকে ইকোপার্কটি স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে ইকোপার্কের উন্নয়ন ও প্রকৃতি রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘সাসটেইনেবল ফরেস্ট্রি অ্যান্ড লাইভলিহুড’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে এই ইকোপার্ক আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।