একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শপথ নেওয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই (৬১ দশমিক ৭ শতাংশ) পেশায় ব্যবসায়ী। এর মধ্যে মহাজোট থেকে নির্বাচিত পেশায় ব্যবসায়ী আছেন ১৭৪ জন (৬০ দশমিক ৪১ শতাংশ) এবং ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত আছেন ৫ জন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য হওয়া ৩ জন পেশায় ব্যবসায়ী।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের সম্পর্কে এসব তথ্য তুলে ধরে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) । আজ রোববার বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর–রুনি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সুজনের তথ্য বলছে, মহাজোট থেকে আসা স্নাতক পাশ সংসদ সদস্য আছেন ১১২ জন এবং স্নাতকোত্তর পাশ আছেন ১২৪ জন। তবে মহাজোট থেকে আসা এসএসসি পাশ করেননি এমন সংসদ সদস্য আছে ১১ জন। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্ট থেকে আসা এসএসসি পাশ করেননি এমন সংসদ সদস্য আছেন ১ জন। আর ঐক্যফ্রন্ট থেকে আসা স্নাতক পাশ সংসদ সদস্য আছেন ২ জন এবং স্নাতকোত্তর পাশ আছেন ২ জন।
সুজন বলছে, নবনির্বাচিত ৬ জন সংসদ সদস্য হলফনামায় তাদের বাৎসরিক আয়ের ঘর পূরণ করেনি। তাঁরা হচ্ছেন– সিলেট–২ থেকে মোকাব্বির খান, খুলনা–৩ এর মন্নুজান সুফিয়ান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ–১ এর সালিম উদ্দিন আহমেদ, পঞ্চগড়–১ এর মোজাহারুল হক প্রধান, ঢাকা–১৭ এর আকবর হোসেন পাঠান ফারুক ও কিশোরগঞ্জ–১ এর প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এ ছাড়া প্রার্থী ও নির্ভরশীলদের সম্পদের ক্ষেত্রে নবনির্বাচিত ৪ জন সংসদ সদস্য সম্পদের তথ্য দেননি। তাঁরা হচ্ছেন– কুমিল্লা–৬ এর আ ক ম বাহাউদ্দিন, চাঁদপুর–১ এর মহিউদ্দিন খান আলমগীর, নারায়ণগঞ্জ–৫ এর সেলিম ওসমান এ কিশোরগঞ্জ–১ এর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই নির্বাচনে অনেক প্রার্থীই তাদের হলফনামা ঠিকভাবে পূরণ করেনি, অসম্পূর্ণ রেখেছেন। অনেকে পেশা উল্লেখ করেননি, সম্পদের হিসেব দেননি। এই অসম্পূর্ণ হলফনামার জন্য তথ্য গোপন করা হয়েছে, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেওয়া হয়েছে।
সুজনের পক্ষ থেকে নির্বাচিত প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। তিনি বলেন, ৩০২ ধারায় বর্তমান ও অতীত উভয় সময়ে মামলায় সংশ্লিষ্ট আছেন ২ জন। একজন মহাজোটের প্রার্থী চট্টগ্রাম–৬ আসন থেকে নির্বাচিত ফজলে করিম চৌধুরী এবং অপরজন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ঠাকুরগাঁও–১ আসনের থেকে নির্বাচিত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
অনেক অযোগ্য ব্যক্তি যারা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্য নন, দণ্ডপ্রাপ্ত এমন ব্যক্তিও নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যারা তথ্য লুকিয়েছেন তাদের মনোনয়ন পত্র গৃহীত হওয়া উচিত নয়। অথচ নির্বাচনে এসব ব্যক্তি অংশ নিয়েছেন, সরকারের সঙ্গে অনেকের ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে কিংবা সরকারি বেতনভুক্ত কর্মকর্তারা— এ রকম ব্যক্তিরাও নির্বাচিত হয়েছেন এবং নির্বাচন কমিশনও এই ব্যাপারে কোনো ভূমিকা পালন করেনি। আমরা আশা করব, যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেসবের তদন্ত করা এবং নির্বাচন কমিশনের সে ক্ষমতাও আছে। এমনকি এগুলো তদন্ত করে ইসি নির্বাচন বাতিলও করতে পারে। সে বিষয়ে কোনো রকম উদ্যোগ আমরা দেখছি না।
নির্বাচনে ভোটের অনিয়মকে ইঙ্গিত করে বদিউল আলম বলেন, ‘যেখানে ইভিএমে ৬টি নির্বাচনী আসনে ৫০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে, সেখানে অন্যান্য আসনে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে। কেন পড়লো? এটা কী ইভিএমের সমস্যা নাকি অন্যগুলো আসনে ভোটের সমস্যা? নির্বাচন কমিশনকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আমরা দাবি করছি, তারা জানাবে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
নির্বাচন কেমন হলো সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন, অভিযোগ উঠেছে। আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব এগুলো তদন্ত করে এগুলো জানানো। নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের অনেকগুলো অভিযোগের কথা বলা হয়েছে।
প্রার্থীদের বৈধতা নিয়ের আদালতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন যখন প্রার্থিতা বৈধ করে তখন আদালত বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতীত, তাঁরা হস্তক্ষেপ করবেন না। কিন্তু আমরা দেখেছি, নির্বাচনের একদিন বা দুই দিন আগে পর্যন্ত আদালত প্রার্থিতা বৈধ করেছে, স্থগিত করেছে এবং স্থগিত করে নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। এখন এরপরে যদি সেসব স্থগিত হওয়া প্রার্থীরা তাদের প্রার্থিতা ফেরত পায় তাহলে কী হবে? শুধু তাই নয়, পঞ্চদশ সংশোধনীতে বলা আছে, আদালতের কোনো বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করা হলে নির্বাচন কমিশনকে নোটিশ দিতে হবে, শুনতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে যথার্থ নোটিশ দিয়েছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।’
বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, একটা ইতিবাচক দিক হলো– এবারের নির্বাচনে অধিক শিক্ষিতরা নির্বাচিত হয়েছেন। বেশি কর প্রদানকারীরা নির্বাচিত হয়েছেন। কতগুলো অশনিসংকেত ও আছে। অধিক ব্যবসায়ী, ধনাঢ্য ব্যক্তিরা নির্বাচিত হয়েছেন। ধনাঢ্য ব্যক্তি, ব্যবসায়ীদের করায়ত্ত হয়েছে আমাদের পার্লামেন্ট। নাগরিকদের ভোটাধিকার থাকলেও তাদের প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ দিনকে দিন সংকুচিত হচ্ছে।
নির্বাচন কেমন হলো—সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকায় আমি শুধু নৌকা মার্কার পোস্টারই দেখেছি, ধানের শিষের কোনো পোস্টার দেখিনি। নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে অনেক লোকের আনাগোনা দেখেছি। আমি ভোটারদের বলতে শুনেছি, দেখেন ওরা গিয়ে গিয়ে ছিল মারছে। এই নির্বাচনে তথ্য সংগ্রহে বাধা ছিল, কোনো উপায় ছিল না।’
নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ছিল উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তবে নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না। ভোটার হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমি এটি পাইনি। স্বতঃস্ফূর্ততা না থাকলে একটা নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না বা তাকে সুষ্ঠু বলা যায় না।’