চিঠিটা যখন এসে বাড়িতে পৌঁছাল, তার প্রায় ১৪ বছর আগে মারা গেছেন প্রাপক। প্রাপকের ভাই ‘একমাত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কার্যে ব্যবহার্য’ লেখা খামটি বুঝে নিলেন। খাম খুলে দেখেন, ছোট ভাই আনোয়ারুল আবেদীনের নাম মুক্তিযুদ্ধের ‘শব্দসৈনিক’ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেটভুক্ত হয়েছে। সেই গেজেটেরই একটি পাতার ফটোকপি রয়েছে খামের ভেতর।
শব্দসৈনিকের বড় ভাই আশফাকুল আশেকীন বলছিলেন, ‘গত বছরের জুন মাসে সে চিঠিখানা হাতে পেয়েছি। আনোয়ারুল আবেদীন মারা যান ২০০৪ সালের ১৬ এপ্রিল। তাঁর ডাকনাম ছিল টুলু। তাঁর মৃত্যুর ১৪ বছর এবং বিজয়ের ৪৭ বছর পর এই স্বীকৃতি আমাকে হতবিহ্বল করে ফেলেছিল।’
আনোয়ারুল ও আশফাকুল যমজ ছিলেন। পাঁচ মিনিটের ছোট ছিলেন আনোয়ারুল আবেদীন।
যুদ্ধদিনের আনোয়ারুল আবেদীন
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের কলকাতায় অবস্থিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রশাসনিক বিভাগে কর্মরত ছিলেন আনোয়ারুল আবেদীন। তিনি একজন শব্দসৈনিক, স্ক্রিপ্ট রাইটার, গীতিকার, কথক শিল্পী ছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিতভাবে ‘মীরজাফরের রোজনামচা’ এবং ‘জনতার আদালত’ নামে দুটি কাউন্টার প্রপাগান্ডা লিখতেন এবং স্বকণ্ঠে প্রচার করতেন।
আনোয়ারুল আবেদীনের স্ত্রী ড. ফরিদা সুলতানা বলছিলেন, ‘আনোয়ারুল আবেদীন যুদ্ধে গিয়েছিলেন পরিবারের কাউকে না জানিয়ে। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাজশাহীর চারঘাটে যেদিন যুদ্ধ হয়, সেদিন চারঘাটের একটি দলের সঙ্গে তিনি ভারতে চলে যান। যুদ্ধে যাওয়ার পরে পরিবারের সদস্যরা ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি হয়তো বেঁচে নেই। পরে তাঁর হাতের লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়, তিনি বেঁচে আছেন।’
আনোয়ারুল আবেদীনের বাড়ি রাজশাহী শহরের বোয়ালিয়া থানার ঘোড়ামারা এলাকায়। তাঁর বাবার নাম মোহাম্মদ ইয়াসিন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি বাংলাদেশ বেতার রাজশাহীতে অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তথ্য অধিদপ্তরে যোগদান করেন। প্রথমে খুলনা বিভাগ ও পরে রাজশাহী বিভাগের উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই পদে থেকেই তিনি অবসর নেন। তিনি বাংলাদেশ বেতারের একজন ‘এ-প্লাস’ গ্রেডের গীতিকার ছিলেন। রম্য লেখক হিসেবেও সুখ্যাতি ছিল। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কোনো দিন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি।
নাম এল পত্রিকায়
২০০৫ সালের ১৩ জুন ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ-এ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট শিল্পী-কর্মীদের ১৭৭ জনের নামের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। ওই তালিকার ৭৬ নম্বর ক্রমিকে আনোয়ারুল আবেদীনের নাম ছিল। এটা দেখার পরে তাঁর স্ত্রী ড. ফরিদা সুলতানা ২০০৫ সালের ৪ জুলাই আনোয়ারুল আবেদীনের নাম মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করেন। তারও এক যুগ পরে এল এই স্বীকৃতি।