ধানের শীষের ১৬১ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন
>• মনোনয়নপত্র জমার সময় ২০ হাজার টাকা জামানত দিতে হয়
• প্রদত্ত ভোটের ৮ ভাগের ১ ভাগ না পেলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়
• বিএনপি-জোটের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা এবার জামানত হারিয়েছেন
• ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ১৪ জন জামানত হারিয়েছিলেন
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকের অন্তত ১৬১ জন প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। জামানত ফিরে পাওয়ার মতো প্রয়োজনীয়সংখ্যক ভোট না পাওয়ায় তাঁদের জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হবে। বিএনপি ছাড়াও ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলো ও ঐক্যফ্রন্টের কয়েকজন বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে এবার নির্বাচনে লড়েছিলেন। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ১৪ জন প্রার্থী জামানত হারিয়েছিলেন।
নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় ২০ হাজার টাকা নির্বাচন কমিশনের অনুকূলে জামানত হিসেবে জমা দিতে হয়। সংসদীয় আসনে মোট প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের এক ভাগ ভোট যদি কোনো প্রার্থী না পান, তাহলে তাঁর জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়।
এবার জামানত হারানো বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন কুমিল্লার দুটি আসন থেকে নির্বাচন করেছিলেন। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কুমিল্লা-২ আসনে তিনি জামানত হারিয়েছেন। এই আসনে তাঁর জামানত রক্ষা করার জন্য ২৯ হাজার ৬০৪ ভোট প্রয়োজন ছিল। তিনি পেয়েছেন ২০ হাজার ৯৩৩ ভোট। বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদ নোয়াখালী-৫ আসনে ১০ হাজার ৯৭০টি ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। এই আসনে বিজয়ী হয়েছেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মোট ভোট পড়েছে ২ লাখ ৭২ হাজার ৬২৩। অর্থাৎ জামানত রক্ষার জন্য মওদুদকে ৩৪ হাজার ৭৭ ভোট পেতে হতো। মওদুদের বিপরীতে ওবায়দুল কাদের পেয়েছেন ২ লাখ ৫২ হাজার ৭৪৪ ভোট।
এ ছাড়া বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, হাফিজ উদ্দিন আহমদ, মজিবর রহমান সরোয়ার, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, মোহাম্মদ শাহজাহান, জেএসডির আবদুল মালেক রতন, জামায়াতের নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রমুখ ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে এবার জামানত হারিয়েছেন। বিএনপি-জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি অলি আহমদও জামানত হারিয়েছেন। তবে তিনি নিজের দলের প্রতীক ছাতা নিয়ে নির্বাচন করেছেন।
এর আগে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল বিএনপির। সেবার বিএনপি পেয়েছিল ৩০টি আসন। জামায়াত পেয়েছিল ২ টি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ওই প্রার্থীদের প্রায় সবাই সংশ্লিষ্ট সংসদীয় আসনের মোট প্রদত্ত ভোটের ৩৩ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। খন্দকার মোশাররফ ৪৪ শতাংশ, মওদুদ আহমদ ৪৯ শতাংশ, মঈন খান ৩৯ শতাংশ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ৩৭ শতাংশ, মজিবর রহমান সরোয়ার ৪৪ শতাংশ, কামাল ইবনে ইউসুফ স্বতন্ত্র নির্বাচন করে ৩৩ শতাংশ, খন্দকার মাহবুব হোসেন ৩৮ শতাংশ, আবদুল্লাহ আল নোমান ৪৪ শতাংশ, মো. শাহজাহান ৪১ শতাংশ, জামায়াতের নেতা মিয়া গোলাম পরওয়ার ৪১ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন।
ইসি সূত্র জানায়, এবারের নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি জামানত হারিয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগের ৩৮টি আসনে। এরপর ঢাকার ৩৪ টি, খুলনার ৩২ টি, বরিশালের ২০ টি, ময়মনসিংহের ১৯ টি, রাজশাহীর ১৫টি ও রংপুরের ৩টি আসনে জামানত হারিয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থীরা।
গত ৩০ ডিসেম্বর ২৯৯টি সংসদীয় আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন ছাড়া ২৯৮টি আসনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট পেয়েছে ২৮৮ আসন। আর বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট পেয়েছে ৭ টি। অবশ্য ঐক্যফ্রন্ট এই নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুনর্নির্বাচন দাবি করেছে।
এবারের নির্বাচনে শুধু আসনসংখ্যা নয়, বিজয়ী প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের হিসাব এবং ভোটের ব্যবধান অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। একইভাবে বিএনপির প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ারও রেকর্ড হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন হলে জামানতের প্রশ্ন আসত। বস্তুত কোনো নির্বাচন হয়নি, ভোট ডাকাতি হয়েছে। যাঁরা বেশি ডাকাতি করেছেন, তাঁদের ভোট বেশি পড়েছে। নির্বাচনের নামে যা হয়েছে, তা দেশের মানুষ দেখেছে।
এবারের সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবি হয়েছে বরিশালে। বরিশাল বিভাগের ২১টি আসনের ২০ টিতেই ধানের শীষের প্রার্থীরা জামানত হারিয়েছেন। এ ছাড়া কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী এলাকায় বিএনপির শক্ত অবস্থান আছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু এসব এলাকায়ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারাসহ বেশির ভাগ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আসন ফেনী-১। এই আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী মুন্সী রফিকুল আলম জামানত হারিয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ২৫ হাজার ৪৯৪ ভোট। জামানত রক্ষার জন্য এই আসনে ভোট প্রয়োজন ছিল ৩০ হাজার ৭০। এই আসনে মহাজোটের প্রার্থী জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার পেয়েছেন ২ লাখ ৪ হাজার ২৫৬ ভোট। একইভাবে ফেনী-১ ও ২, নোয়াখালী ১,২, ৪,৫ ও ৬, লক্ষ্মীপুর-১,২ ও ৩ আসনেও ধানের শীষের প্রার্থীরা জামানত হারিয়েছেন।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী এলাকা হিসেবে পরিচিত রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জের প্রায় সব আসনেই ধানের শীষের প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
ধানের শীষের প্রার্থীদের যাঁরা জামানত রক্ষা করতে পেরেছেন, তাঁদের বেশির ভাগ উত্তরবঙ্গ, সিলেট ও ঢাকার। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের প্রায় সবাই জামানত রক্ষা করতে পেরেছেন। ঢাকা বিভাগের মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকার ১১টি আসনে ধানের শীষের প্রার্থীদের জামানত রক্ষা হয়েছে। তবে ঢাকা-২ ও ৩ এবং ঢাকা-১৯ ও ২০ আসনে ধানের শীষের প্রার্থীর জামানত রক্ষা হয়নি।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত দেখা যায়, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি হারলেও তাদের একটি বড় ভোটব্যাংক থাকে। ১০ বছরের ব্যবধানে এভাবে একটি দলের ভোট কমে যাওয়া, যেখানে বিএনপির অবস্থান শক্ত বলে মনে করা হয়, সেখানেও দলটির প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার মতো ঘটনা অস্বাভাবিক। সঠিক তদন্ত হলে এর আসল কারণ বের হয়ে আসবে। আর বিএনপি যে অভিযোগ করছে, তারা যদি তথ্য-প্রমাণ আদালতে বা নির্বাচন কমিশনে হাজির করতে পারে, তাতে হয়তো কারণটা বোঝা যাবে।