যশোর–বেনাপোল সড়কের পাশে কাগজপুর বাজার। এই বাজারে ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নির্বাচনী পথসভা হচ্ছিল নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শেখ আফিল উদ্দিনের। মঞ্চে তখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন ৪ নম্বর কাগজপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবর আলী। একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘জামাত–বিএনপির লোকেরা কানাঘুষা করছে, আর্মি (সেনাবাহিনী) নামলে ওরাও মাঠে নামবে। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, জামাত–বিএনপিকে আমরা মাঠে নামতে দেব না।’
মঞ্চে ছিলেন যশোর–১ আসনের সাংসদ ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ আফিল উদ্দিন। তিনিও বিএনপির নেতা–কর্মীদের হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ‘আপনারা এক পা এগোলে আমি দশ পা এগোব।’
নির্বাচনী এলাকায় আফিল উদ্দিনের পোস্টার, ব্যানার আর মাইকের আওয়াজে মনে হয় ৩০ তারিখের সংসদ নির্বাচনে তিনি একাই প্রার্থী। প্রায় প্রতিদিন ছয়-সাতটি পথসভা করছেন। কোনো কোনোটি জনসভার চেহারা পাচ্ছে। ২২ ডিসেম্বর দুপুরের পর বেনাপোলে তাঁর একটি সভায় আসা কয়েক শ মানুষকে খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়।
কেন মাঠে নেই বিএনপি
আওয়ামী লীগের হুমকি, মারধর ও মামলার কারণে পথসভা বা জনসংযোগ করতে পারছেন না বলে জানান বিএনপির প্রার্থী মফিকুল হাসান তৃপ্তি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা পুলিশ, থানা–পুলিশ ও শার্শার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে কথা বলে প্রচারে যেতে হয়। তাঁরা যদি বলেন পরিস্থিতি ভালো না, তাহলে আর যাওয়া হয় না।’ তাঁর দাবি, বিএনপির কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কর্মীরা। তাঁরা বলছেন, কেউ যেন ধানের শীষের পোস্টার না লাগান। কেউ যেন বিএনপির মিছিল–মিটিংয়ে না যান।
শার্শার ইউএনও পুলক কুমার মণ্ডল বলেন, ‘মফিকুল ইসলাম তৃপ্তি যে সময় নিরাপত্তা চাচ্ছেন, আমরা তাঁকে সে সময় নিরাপত্তা দিচ্ছি। নিরাপত্তা পেয়ে তিনি গত সোমবার বেনাপোল ও নাভারণে মিছিল করেছেন।’
তবে বিএনপির প্রার্থী বলেন, এত মামলা হচ্ছে যে নেতা-কর্মীদের পুলিশের কাছ থেকে ছাড়াতে গিয়ে দিনের প্রায় পুরোটা সময় চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘গত ২০ দিনে ৬০০ নেতা-কর্মীর জামিন করিয়েছি। ২০০ জনের জামিনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের হামলায় ৯০ জন আহত হয়েছেন। ভেবেছিলাম সেনা মোতায়েনের পর পরিস্থিতি একটু ভালো হবে, কিন্তু তা হয়নি।’
শার্শা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম মশিউর রহমান বলেন, ‘প্রার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। আমরা তাঁকে (বিএনপির প্রার্থী) নিরাপত্তা দিয়েছি। পুলিশ ও বিজিবির নিরাপত্তা নিয়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনী গণসংযোগ করেছেন।’
সরেজমিন শার্শা
সীমান্তবর্তী শার্শা উপজেলা নিয়ে যশোর-১ আসন। ১১টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভাসহ দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল এই আসনের অন্তর্ভুক্ত। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ার এখানকার অপরাধের ঘটনা বেশি বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। চোরাচালানের সঙ্গে এলাকার অনেক প্রভাবশালী জড়িত। খুন করে বা সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে দুষ্কৃতকারীরা সহজে ভারতে পালিয়ে গেছে, এমন নজির অনেক বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সীমান্তে চোরাচালান ও গরুর হাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বে শর্শা উপজেলায় গত ৯ বছরে ৪১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় সাংবাদিকেরা জানান।
উপজেলার সামটা গ্রাম একসময় আলোচিত হয়েছিল আর্সেনিকের প্রকোপের কারণে। প্রায় ২০ বছর আগে গ্রামের বহু মানুষ আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হন, বেশ কয়েকজন মারা যান। এই গ্রামের ছোট বাজারের উন্মুক্ত স্থানে রয়েছে নৌকার একটি নির্বাচনী ক্যাম্প।২২ ডিসেম্বর বাজারে গিয়ে নৌকা ছাড়া অন্য কোনো প্রতীকের পোস্টার চোখে পড়েনি। বাজারের একটি চায়ের দোকানে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। চা–দোকানি বলেন, নৌকা প্রার্থীর কর্মীরা জামাত–বিএনপির সমর্থক বলে পরিচিত বাড়িগুলোতে গিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে নিষেধ করেছেন। আপনি কি ভোট দিতে যাবেন—প্রথম আলোর এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘চিন্তায় আছি, এই বয়সে রাস্তায় যদি অপমান করে।’
সামটা গ্রাম থেকে বের হওয়ার পর জামতলা বাজার। দেশজুড়ে এই বাজারের মিষ্টির সুনাম রয়েছে। ২২ ডিসেম্বর দুপুরে পাঁচজন কর্মীকে নৌকার পোস্টার লাগাতে দেখা গেল। একটু দূরে নৌকার প্রচারের মাইকের আওয়াজ। স্থানীয় এক যুবক জানালেন, বিএনপির লোকেরা পোস্টার লাগাতে আসেননি।
উপজেলার সীমান্তঘেঁষা একটি বাজারের নাম বারপোতা। দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, একটি দোকানে কে বা কারা রাতে ধানের শীষের পোস্টার লাগিয়েছিল। নৌকার সমর্থকের তা তুলে ফেলেছেন।
২২ ডিসেম্বর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বারপোতা, জামতলা, সামটাসহ শার্শা উপজেলার বেশ কিছু বাজার ও গ্রাম এবং বেনাপোল বন্দর এলাকায় মোটরসাইকেলে করে ঘুরেছিলেন এই প্রতিবেদক। এসব এলাকার কোথাও ধানের শীষের পক্ষে কোনো প্রচার চোখে পড়েনি, পোস্টার–ব্যানার দেখা যায়নি।