একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে প্রথম দল হিসেবে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি—সিপিবি ইশতেহার ঘোষণা করেছে। বড় দলগুলোর সমালোচনা করে তারা বলেছে, তারা অযৌক্তিক, অবান্তর বিষয়গুলো নিয়েই বেশি আলোচনা করে। ফলে নির্বাচনের কোনো ‘হেলদি পরিবেশ’ থাকে না।
আজ শনিবার রাজধানীর পুরানা পল্টনের মুক্তিভবনে দলীয় কার্যালয়ে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এই ইশতেহার ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, দেশ বহুদিন ধরে দ্বিদলীয় দুঃশাসনের বৃত্তে আটকা পড়েছে। ফলে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। নৌকা বা ধানের শীষ নীতি–আদর্শের বালাই না করে নিজেদের সুবিধামতো রাজনীতি করে, তারা ‘মোর দেন সেম’ (একই জিনিস)। এই বৃত্ত ভাঙতে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা পাল্টে দিতে হবে ।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে গেছে। এই পরিবর্তন যে সম্ভব, তা সাম্প্রতিক অনেক ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন, যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিশোর বিদ্রোহ, সুন্দরবন ও জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন প্রমাণ করেছে সঠিক নির্দেশনা পেলে এই দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
সিপিবির ইশতেহারে ৩০টি ধারা ও ১৫১টি উপধারা রয়েছে। তাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধান, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও রাজনীতির সংস্কার সাধন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন, নাগরিকদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার নিষিদ্ধ করার মতো বিষয়গুলো রয়েছে। এ ছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বৈষম্য হ্রাস, ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে শূন্যসহিষ্ণুতা (জিরো টলারেন্স) নীতি গ্রহণ, বিকল্প অর্থনৈতিক নীতি ও ব্যবস্থাপনা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-দুর্বৃত্তায়ন-মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, কৃষি, কৃষক, গ্রামীণ মজুরের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জীবনমান উন্নয়ন, দেশীয় শিল্পের বিকাশ, শ্রমিক ও কর্মচারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জীবনমান উন্নয়ন, শিক্ষা ও চিকিৎসার নামে ব্যবসা বন্ধ, তারুণ্যের সম্পদ কাজে লাগানো, শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধ-দুস্থদের অধিকার নিশ্চিত করা, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার মতো বিষয়গুলো রয়েছে।
ইশতেহারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, সম্প্রচার নীতিমালার সংস্কার, স্থানীয় সরকারের হাতে বাজেটের নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে সংসদকে তদারকি ও আইন প্রণয়ন সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, রুটিন কাজের নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান সংবিধানে যুক্ত করা, নিচ থেকে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পরিচালনা, ‘কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা স্কিম’ চালু, ন্যায়পাল চালু ও দুদককে শক্তিশালী করা, উৎপাদক সমবায় ও ক্রেতা সমবায় গঠন করে তাঁদের মধ্যে সরাসরি মার্কেটিং চালু করা, আমূল ভূমি সংস্কার, নতুন শ্রম আইন প্রণয়ন, শিক্ষার মানোন্নয়ন, ইউনিয়নে মাতৃসদন, শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষা কেন্দ্র ও গণস্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র গড়ে তোলা, জাতিসংঘ পানি প্রবাহ আইন ১৯৯৭ এ অনুস্বাক্ষর করা এবং জোট-নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের মতো বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে।
ইশতেহার প্রকাশ উপলক্ষে আজকের সংবাদ সম্মেলনে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘আমাদের ইশতেহার গ্রাম অভিমুখী, গরিববান্ধব। লুটপাট করে যাঁরা সম্পদের মালিক বনেছেন তা পুনর্বণ্টন করে গরিব জনগণের স্বার্থে এবং জাতির উন্নয়নে ব্যয় করব। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব। আমাদের সমস্ত কার্যক্রম চলবে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের ভিত্তিতে। রাজনীতিতে কেবল সংসদের ওপর ভিত্তি করে কার্যক্রম চলবে না। সংসদ আইন প্রণয়ন করবে, তদারকি করবে। কিন্তু রাষ্ট্রের বিশাল অংশের কাজ হবে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে।’
এক প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আর অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন এক না। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিস্থিতি দেশে নেই। তিনি বলেন, দেশের সামাজিক ব্যবস্থা কী হবে; রাজনীতি, অর্থনীতি কেমন হবে, সেগুলো নিয়ে বড় দলগুলো আলোচনা করে না। তারা অযৌক্তিক, অবান্তর বিষয়গুলো নিয়ে তর্কবিতর্ক করে থাকে। তারা এসব নিয়ে কথা বললে হেলদি ডিবেট হবে।
এ সময় সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম, সহসাধারণ সম্পাদক কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, প্রেসিডিয়াম সদস্য লক্ষ্মী চক্রবর্তী, আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন, অনিরুদ্ধ দাশ অঞ্জন, সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, আহসান হাবিব লাবলু, জলি তালুকদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।