লবণাক্ততার কারণে উদ্বাস্তু হবে মানুষ
মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের উপকূলের প্রায় দুই লাখ কৃষক বাস্তুচ্যুত হবেন। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূল অঞ্চলের মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে ধান চাষের অনুপযোগী হলে কৃষক এলাকা ছাড়বেন। নতুন একটি গবেষণার অনুমিত হিসাবে এ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটি ও অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে এ গবেষণা করেছেন। গবেষণা প্রবন্ধটি গত ২৩ অক্টোবর নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ সাময়িকীতে ‘কোস্টাল ক্লাইমেট চেঞ্জ, সয়েল স্যালাইনিটি অ্যান্ড হিউম্যান মাইগ্রেশন ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ছাপা হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, ঘন ঘন নোনা পানির প্লাবন ইতিমধ্যে বহু কৃষককে ধান চাষ ছাড়তে বাধ্য করেছে। কৃষক এখন ধানের জমিতে চিংড়ি বা অন্য সামুদ্রিক মাছের চাষ করছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলের নদী-খালে লবণপানি যে বাড়ছে, তার প্রমাণ আছে। তবে মনে রাখতে হবে, উপকূলে বেড়িবাঁধও আছে। বাঁধের কারণে নোনা পানি ফসলের জমিতে প্রবেশে বাধা পায়। মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে ধানের উৎপাদন কমছে, এমন উপাত্ত নেই। অন্য বিষয়টি হচ্ছে, মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়ার মতো জায়গা দেশে নেই। এ দেশের মানুষের নোনা পানির সঙ্গে খাপ খাইয়ে বসবাস করার অভিজ্ঞতা আছে।
ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির কৃষি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক জোসি চেন ও অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ভ্যালেরি মুলার উপকূলের জেলাগুলোর ১৪৭টি উপজেলার মানুষের অভিবাসনের আর্থসামাজিক উপাত্ত নিয়েছেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০০৩ ও ২০১১ সালের স্যাম্পেল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন (এসভিআরএস) থেকে। তাঁরা কৃষি উৎপাদনের উপাত্ত নিয়েছেন বিবিএসের ২০০৫ ও ২০১০ সালের আয় ও ব্যয় খানা জরিপ থেকে। প্লাবনবিষয়ক উপাত্তের সূত্র যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনেটিকস্ অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নাসা) উপগ্রহের তথ্য। মূলত এই তিন ধরনের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে (মডেলিংয়ের মাধ্যমে) তাঁরা বাংলাদেশের উপকূলে নোনা পানির প্লাবন, মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও মানুষের অভিবাসন নিয়ে এই পূর্বাভাস দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁরা আগের কিছু গবেষণার তথ্যও বিশ্লেষণের কাজে ব্যবহার করেছেন। গবেষকেরা বলছেন, তাঁরা অভিবাসনের ক্ষেত্রে লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রভাব দেখতে চেয়েছেন। প্লাবনের প্রভাব এই হিসাবের মধ্যে নেই।
গবেষকদের অনুমিত হিসাব বলছে, মাঝারি ধরনের লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে একটি খামারের কৃষি আয় বছরে ২১ শতাংশ কমে যাবে। আগামী ১২০ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের উপকূলে বসবাসকারী ১৩০ কোটি মানুষের বসতি সমুদ্রের পানিতে ডুবে যাবে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিজমির ৪০ শতাংশ মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়বে। ইতিমধ্যে উপকূলের মানুষ ঘন ঘন প্লাবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করছে।
জোসি চেন যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমকে বলেছেন, অনেক কৃষক ইতিমধ্যে ধান চাষের জমি চিংড়ি বা সামুদ্রিক মাছ চাষের খামারে রূপান্তর করেছেন। চিংড়ি বা ওই সব সামুদ্রিক মাছ আধো নোনা পানিতে (ব্রাকিস ওয়াটার) ভালো উৎপাদন করা যায়।
গবেষণায় অভিবাসন বিষয়ে দৃষ্টি কাড়ার মতো তথ্য দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, জলবায়ুর প্রভাবজনিত কারণে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ২৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। কিন্তু মানুষের বিদেশ যাওয়া ৬৬ শতাংশ কমে যাবে। বিদেশ যাওয়া কমে যাওয়ার একটি কারণ হবে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। চিংড়ি ও মাছ চাষ অনেক মানুষকে কাজ দেবে। গবেষণায় একটি চিত্রে দেখানো হয়েছে, লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষের অভিবাসন হবে নিজের জেলায়। অন্য চিত্রে দেখানো হয়েছে, ৬০ হাজার মানুষের অভিবাসন হবে অন্য জেলায়। সে ক্ষেত্রে অভিবাসী মানুষ ঢাকাকে আশ্রয়স্থল হিসেবে বেশি প্রাধান্য দেবে। সেই তুলনায় উত্তরের জেলাগুলোতে অভিবাসন কম হবে।